বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা বড় উপহার দিয়েছেন দেশের সংখ্যালঘুদের। পাকিস্তান আমল থেকে গত ৬০ বছর ধরে শত্রু সম্পত্তি আইনের ফাঁসে বেদখল হয়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি প্রকৃত মালিক বা উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি বিল সম্প্রতি সংসদে পাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিলের নাম ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) বিল ২০১১’। এই বিল পাস করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চেপে বসা হয়রানি আর বঞ্চনার অবসানের প্রক্রিয়া শুরু হল। নতুন আইনে বাংলাদেশের নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে অর্পিত সম্পত্তি (শত্রু সম্পত্তি) ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। আইন তৈরির ১৫০ দিনের মধ্যে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তির মৌজাভিত্তিক তালিকা তৈরি করবে সরকার।
নবজাতক বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছিলেন মুজিবর রহমান। পরবর্তী কালে ইসলামি মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিতে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দেয় স্বৈরশাসকেরা। এ বার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি শত্রু সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার কার্যকর প্রক্রিয়ার সূচনা নিশ্চিত ভাবেই মুজিব-কন্যার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে হাসিনা কেবল ইসলামি মৌলবাদকেই বড়সড় ধাক্কা দেননি, গোটা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সেকুলার ভাবমূর্তিকে আবার প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন।
শত্রু সম্পত্তি আইন নামে অধিক পরিচিত হলেও ওই অমানবিক আইন বিভিন্ন সময়ে বহু বার নাম বদল করেছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর তার প্রয়োগ বহাল থেকেছে সমান ভাবে। দাঙ্গা বা স্বৈরাচারী শাসকদের দমন নীতি ব্যতিরেকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা প্রতিদিন দেশত্যাগ করেছে। আওয়ামি লিগের সংক্ষিপ্ত শাসন কাল বাদ দিলে হিন্দুদের বাংলাদেশ ত্যাগ ধারাবাহিক ভাবে অব্যাহত থেকেছে। ২০০৬ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত হিন্দুরা দেশত্যাগের ধারা অব্যাহত ছিল। তার প্রধান কারণ অবশ্যই ওই শত্রু সম্পত্তি আইন।
|
‘বিলীয়মান সংখ্যালঘু জনসংখ্যা’ কথাটি বাংলাদেশে খুব চালু। সে দেশের জনগণনা রিপোর্টে সংখ্যালঘুর ধারাবাহিক হারিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে। ১৯৪১ জনগণনার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুু ছিল ২৮%। ১৯৫১ সালে ছিল ২২%, ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ১৩.৫% (মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭১ সালে জনগণনা হয়নি), ১৯৮১ সালে ১২.৫%, ১৯৯১ সালে ১০.৫% আর ২০১১ সালে ৯.৬%। সংখ্যালঘুর দেশত্যাগ নিয়ে বাংলাদেশে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। সংবেদী শিক্ষিত সুশীল সমাজের মানুষ এককাট্টা হয়ে দাঙ্গায় দুর্ভোগে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবু শত্রু সম্পত্তি আইনের জাঁতাকলে পড়ে সংখ্যালঘুর দেশত্যাগ অব্যাহত থেকেছে।
শত্রু সম্পত্তি আইন সংখ্যালঘুদের পক্ষে যেমন ছিল বঞ্চনার, অপমানের এবং ভিটে হারানোর বিধান, তেমনই তা স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ছিল অনায়াসে বিপুল সম্পত্তি হাতানোর হাতিয়ার। আর ওই রাজনীতির লোকেদের সব সময়েই সঙ্গ দিয়েছেন এক শ্রেণির আমলা। যে কারণে নতুন অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনকে স্বাগত জানানোর পরেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো আইনের কয়েকটি ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। সম্পত্তি ফেরানোর জন্য যে কমিটি তৈরি হবে তার দায়িত্বে থাকবেন এক আমলা এবং স্থানীয় সাংসদের দুই মনোনীত প্রতিনিধি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অভিযোগ, এতে সমস্যা সৃষ্টি হবে। পরিষদ চায়, বিষয়টা ট্রাইবুনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক।
পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির যে হিসেব দেওয়া হয়েছে তাও বিপুল,তালিকাভুক্ত মোট অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ৬ লাখ ৪৩ হাজার একর। তার মধ্যে প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তি মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার একর। কারণ এইটুকুই সরকারের দখলে রয়েছে। বাকিটা ব্যক্তিগত দখলে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে শত্রু সম্পত্তি কিংবা অন্য কোনও নামে সংখ্যালঘুদের ওই সব সম্পত্তি দখল হয়ে গিয়েছে। অনেক সময়েই হিন্দুদের দেশত্যাগ করারও প্রয়োজন হয়নি, তিন ভাইয়ের এক ভাই দেশ ছেড়েছে বলে তাদের পুরো সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে বেদখল হয়ে গিয়েছে। এ রকম বহু হিন্দু বাংলাদেশে আছেন, যাঁরা শত্রু সম্পত্তি আইনের ঘোরপ্যাঁচে সম্পত্তি হারিয়ে নিজের জমিতেই দিনমজুর খাটেন।
এহেন দুর্ভোগের যে আইন তা তৈরি হয়ে যায় পাকিস্তান সৃষ্টির চার বছরের মধ্যে। হিন্দুদের ফেলে আসা সম্পত্তির তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ এবং রক্ষার জন্য ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যক্ত (স্থাবর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান) আইন তৈরি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের যে স্থায়ী বাসিন্দারা ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অথবা তার ভয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসেন, ওই আইনে তাঁদের সম্পত্তি পরিত্যক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশত্যাগ করেন। তাঁদের সেই ফেলে আসা সম্পত্তি রাষ্ট্র ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করে। পাকিস্তান ওই সময়ে ছিল সামরিক শাসনাধীন। বস্তুত পাকিস্তানের প্রায় পুরো সময়কালটাই ছিল কোনও স্বৈরশাসক বা কোনও সামরিক শাসকের অধীন। ওই সময় সরকার-বিরোধী যে কোনও আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী হিন্দুদের বা কমিউনিস্টদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। এবং তার পরিণতিতে লাখ লাখ হিন্দু পরিবার তাঁদের জমি-জিরেত সম্পত্তি হারিয়েছেন পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন বা ‘পূর্ব পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি পুনর্বাসন অধ্যাদেশ ১৯৬৪’-র নামে। সরকারের যুক্তি ছিল, ওই আইন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে দ্রুত ক্ষতিপুরণ পেতে সাহায্য করবে।
বাস্তবে তা হয়নি। হিন্দু তথা সংখ্যালঘুর জমি বা অন্যান্য সম্পত্তি অবাধে বিক্রি বা হস্তান্তরের অধিকার কেড়ে নিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন ওই অধ্যাদেশ ব্যবহার করেছে। সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের জন্য জেলাশাসকের অনুমতি নিতে হত। আইনি জটিলতার ফলে উপায় থাকলেও জমি বাড়ি বিক্রি না করে বহু হিন্দু পরিবারকে সব ফেলে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। ওই বছরই জারি হয় ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’। অর্থাৎ আগে হিন্দুদের যে সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলা হত তা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হল। কারণ পাকিস্তান ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র ঘোষণা করে। ১৯৬৪ সালের অধ্যাদেশটি ১৯৬৯ সালে বাতিল করা হলেও শত্রু সম্পত্তি আইনটি বলবৎ থাকে। তবে ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি আইনের নাম বদল করে ‘শত্রু অর্পিত সম্পত্তি আইন’ করা হয়। ওই আইন প্রয়োগ করে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী লোকেরা হিন্দুদের বহু সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে।
|
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি হয়। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বহু প্রত্যাশা সত্ত্বেও শত্রু সম্পত্তি আইন বিলোপ করা হয়নি। বরং ১৯৭২ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন অপরিবর্তিত রেখে নতুন নাম হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। ১৯৭৪ সালে অর্পিত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে ভেবেছিলেন অনেকেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমান নিজ বাসভবনে সপরিবার খুন হওয়ার পরে স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশে এক চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বাংলাদেশ আবারও দীর্ঘ এক সময়ের জন্য চলে যায় সামরিক শাসক বা স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পরে সামরিক সরকার ১৯৭৬ সালে একটি অধ্যাদেশ জারি করে অর্পিত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা নয়, হস্তান্তর ও বিক্রির ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচারী সরকার যে কাজ করতে পারেনি, জিয়াউর রহমানের সরকার সেই কাজটাই করে দেখাল। তিনি নিহত হওয়ার পরে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে হিন্দুদের জানিয়ে দেন, নতুন করে কোনও হিন্দু সম্পত্তি অর্পিত ঘোষণা করা হবে না। অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরও করা হবে না। ওই প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়। কিন্তু তা কোনও দিনই কার্যকর হয়নি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন আওয়ামি লিগ সরকার ২০০১ সালে, মেয়াদের শেষ সময়ে, শত্রু সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার জন্য আইন পাস করে। কিন্তু খালেদা-নিজামি জোট ক্ষমতায় গিয়ে ওই আইন কার্যকর করেনি। সেই আইনে কয়েকটি সংশোধনী এনে নতুন করে পাশ করা হল। এ বার প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে, জানিয়েছে সরকার। |