মোমবাতির মতো সুন্দর জিনিস কি আর হয়? কী মায়া তার আলোয়, কী রোমাঞ্চ, কী প্রতিশ্রুতি। কত নরম। কত স্নিগ্ধ। এত স্নিগ্ধ যে মোমের আলোয় যেন মিশে থাকে মন-ভোলানো মমতা। শরীর মনের কোনায় কোনায় জমে-যাওয়া ক্লান্তি আর ক্লিন্নতা দূর করার জন্য তাই মোমবাতি-আলোর শুশ্রূষাই শ্রেষ্ঠ। মোম হাতে নিয়ে যখন কেউ দাঁড়ায়, নিশ্চয়ই এই শুশ্রূষার কথাই বলে সে। মোম হাতে নিয়ে যখন কেউ হাঁটে, প্রতিশ্রুতির পথে হাঁটার কথাই ভাবে। আর, মোম হাতে নিয়ে যখন কেউ প্রতিবাদ করে? সেই আবছা-আলোয় নিশ্চয়ই মিশে থাকে অন্যায় রোধ করার প্রতিজ্ঞা। মরমি, স্নিগ্ধ প্রতিজ্ঞা। মন-ভোলানো প্রতিজ্ঞা।
মন-ভোলানোই বটে! তাই হয়তো অধিকাংশ মোমবাতির মিছিলের শেষে হাতে আর কিছুই থাকে না। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে প্রতিবাদ, মোমের আলোর আলতো আভায় প্রতিবাদীরও মন ভোলে, ভুলেই যায়। শেষ পর্যন্ত মোলায়েম মোম প্রতিবাদের অশান্তির উপর স্নিগ্ধতার প্রলেপ ফিরিয়ে আনে। জাগরূক হয়ে থাকে শুধু বিস্মৃতির স্নিগ্ধতা, প্রতিবাদহীনতার স্নিগ্ধতা। |
যে নব্বই জন মানুষ সে দিন আগুনের সেই স্নিগ্ধ রূপ ছাড়িয়ে বড্ডই বেশি দূরে চলে গিয়েছিলেন, আগুনের ভয়াল গ্রাসের মধ্যে যাঁদের একটি একটি করে মুহূর্ত কাটছিল আর একটি একটি করে শ্বাস আটকে আসছিল, তাঁদের জন্য এ বারও, আবারও কি আমরা সেই মোম-প্রতিবাদেই নিজেদের মিলিয়ে দেব? এই যে অসামান্য গ্যাস চেম্বার, সাত সাগর পারে নয়, ঘরের পাশে যার সর্ব রকম ব্যবস্থা প্রস্তুত, অনেক যত্নে, অধ্যবসায়ে, অনেক মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে আমাদের অসুস্থ প্রিয়জনদের ‘স্লো-ডেথ’-এর এই যে অপূর্ব নিখুঁত ব্যবস্থা, সেই অসাধারণ নিধনের প্রতিবাদে মমতাময় মোমকেই আবারও বেছে নেব? স্বহস্ত-রচিত করাল আগুনের বিষ-ধোঁয়ার উত্তরে তুলে ধরব স্নিগ্ধতার শিখা? অপদার্থ হন্তারক ব্যবস্থার বিরুদ্ধতার জন্য রচনা করব এমন মিষ্টি প্রতিজ্ঞার আলপনা?
কেন এই অকারণ স্নিগ্ধতার চর্চা? কেন এই শোভনতার নাছোড় সংস্কৃতি? স্থান-কাল-পাত্র বিচার করে মুখর হয় না যে প্রতিবাদ, তার মতো অসার, অশোভন, অসহ্য আর কী হতে পারে? এমন অমানুষিক ঘটনা সারা বিশ্বে কমই দেখা গিয়েছে এই সভ্যতাকালে, আকস্মিক দুর্ঘটনা হলেও আমাদের নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এই দুর্ঘটনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে, অথচ সেই ঘটনার পর দিনই ঠিক কোন মন নিয়ে আমরা মোমের মিছিলে নেমে আসতে পারি?
কেন পারি, সেই প্রশ্নের উত্তরটা বোধহয় কঠিন নয়। আসলে, প্রতিবাদ-মিছিলের গোড়াকার ভাবনা যত শক্তপোক্তই থাক না কেন, আমাদের আশ্চর্য ক্ষমতায় আমরা তাকে লঘু করে প্রতীকী প্রতিবাদে পর্যবসিত করতে পারি। প্রতীকী প্রতিবাদ। কথাটা ভাল। যে প্রতিবাদ কেবল প্রতীকেই সীমাবদ্ধ, সেটাই প্রতীকী। প্রতীক হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে অনেক দূর যাওয়ার দম লাগে না। অনেক দূর যাব কী করে, আমরা যে জানি, আমরাই পুড়িয়ে মারি, আবার আমরাই মোমবাতি নিয়ে হাঁটি।
আমরাই পুড়িয়ে মারি। নিশ্চয়ই আমরা হাড়ে হাড়ে জানি যে, আজ না হয় তো কাল, কাল না হয় তো পরশু, নরম শুশ্রূষাময় এই মোমের আলো নিবে গেলেই সব শেষ হয়ে যাবে! মোমবাতি গলে যায়, ফুরিয়ে যায় প্রতিবাদী আঁচ, ঠিক যেমন রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনার পর হয়েছিল। মনে আছে, কী প্রত্যয় ফুটে উঠেছিল লক্ষ মোমের আঁচে, ভুলব না, ভুলতে দেব না, শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত মোম নিবতে দেব না, ইত্যাদি! কোনও দাবি, কোনও প্রতিবাদই আমরা মনে রাখতে পারি না, তাই যে অমানুষিক ব্যবস্থা সকলে মিলে তৈরি করে রেখেছি চার পাশে, তা যেমনকার তেমনই চলতে থাকে, ঠিক যেমন হয়েছিল স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পর। ক’দিনের ফাঁকা আওয়াজ ক্রমে স্নিগ্ধতায় বিলীন হয়ে গেল, শহরের অন্যান্য বাড়ি তো দূরস্থান, ওই কালান্তক স্টিফেন কোর্ট, আকারেপ্রকারে যা নাকি সম্পূর্ণ বেআইনি, তারও কোনও পরিবর্তন হল না। মোম নিবে গেল। আমরা ভেবে দেখলাম, যা চলছে চলুক, খুব সম্ভবত ‘আমার’ কিছু হবে না, ‘আমি’ বেরিয়ে যাব, ঝামেলা যা হওয়ার সেগুলো অন্যদের উপর দিয়েই যাবে। ঠিক যেমন নন্দরাম মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পর! মার্কেট বিল্ডিং বেআইনি, বিপজ্জনক, এই সব বিবিধ রবে প্রশাসন সবে হেলেদুলে বসেছে, সামান্য কিছু পরিবর্তনের প্রয়াস দেখা দিচ্ছে, তখনই পাড়ার বাসিন্দা এই আমরা-ই আটকে দিলাম সে সব, কী লাভ ঝঞ্ঝাটে! ভাঙাভাঙি? নাড়ানাড়ি? কী দরকার! থাক না জগদ্দল, যেমন আছে তেমন! ‘আমার’ তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না! সুতরাং, এই সব জেনে এবং মনে রেখে আমরা মাঝেই মাঝেই মিছিল করি, আর সেই মোম-মিছিলের ‘লাইভ কভারেজ’ চলতে থাকে নিউজ চ্যানেলগুলোয়, আর মোম-আলোকিত মুখচ্ছবির নীচ দিয়ে চলতে থাকে ব্রেকিং নিউজ-এর স্ক্রোল: আবার আগুন, শহরের অন্য প্রান্তে, বিরাট বিপর্যয়, বহু ক্ষয়ক্ষতি!
সাম্প্রতিক কালে একটি প্রতিবাদ মিছিলই আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, ‘কিছু একটা’ করতে সমর্থ হয়েছে, যার নাম নন্দীগ্রাম! কিন্তু সেখানে যে সেই মিছিলকে দু’হাতে আগলে নিয়েছিল দল-রাজনীতির দুনিয়া। মিছিল মোমবাতি সকলই যখন ফুরাল স্বপনপ্রায়, দলীয় রাজনীতির কোন্দলে তার নতুন জন্ম হল, প্রতিবাদ এক রকম থেকে অন্য রকমের হয়ে গেল। সেই পরিবর্তন-এর বাইরে যেটুকু পড়ে রইল, তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না ক’দিন পর। মনে করিয়ে দিল, দল-ছাড়া রাজনীতির জায়গা আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। হয়তো মোমবাতির মধ্য দিয়ে তেমনই একটা ‘অন্য’ দাঁড়ানোর জায়গার সন্ধান করা হয়েছিল গোড়ায়, কিন্তু মোমের মতোই তা গলে নশ্বর হয়ে গেল।
সব মিলিয়ে তাই, আমাদের এই শহর মোম-প্রতিবাদের শহর। যখন প্রতিটি নাগরিকের ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার কথা, ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে নিশ্চিত করার কথা যে, শহরের, রাজ্যের সব হাসপাতাল, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বৃহৎ আবাসন সর্বত্র যে ব্যবস্থা চলছে, চলে আসছে, তা সমূলে পালটাতে হবে, তখনও চলছে শোভন শান্ত মিছিল, এবং ইতিমধ্যেই ক্ষীণ হয়ে আসছে তার কণ্ঠ। অগ্নি-বিপর্যয়ে তবু মোমবাতি দেখা যায়। কিন্তু একের পর এক ভয়াবহ রেল বিপর্যয়, বাস বিপর্যয় ঘটে যায় কেবল ব্যবস্থার দোষে, মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়, তার জন্য স্নিগ্ধ মোমবাতিটুকুও জোটে না। কখনও দেখেছি কি, স্বাস্থ্য-অব্যবস্থার প্রতিবাদে, পরিবহণ-অব্যবস্থার প্রতিবাদে, শিক্ষা-অব্যবস্থার প্রতিবাদে কেউ আন্দোলনের কথা ভাবছেন?
এ ভাবে হবে না। জোর লাগবে। মুষ্টিবদ্ধ প্রতিজ্ঞার জোর। তার জন্য সব সময় দলীয় রাজনীতির ধাঁচায় ঢুকতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। ধাঁচা ছাড়াও হয়। পালটানো যায়। জোর থাকলে, জোর রাখতে পারলে অবশ্যই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা যায়। অন্তত ব্যবস্থা ভাঙার দাবিটুকু নাছোড় ভাবে ধরে রাখা যায়। ২০১১ কিন্তু অন্যত্র সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, পালটাতে চাইলে পালটানো যায়।
২০১১। বছরটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও তারে বাঁধতে চাইলে নিশ্চিত ভাবেই একটিই তার পাওয়া সম্ভব, সেটা প্রতিবাদের তার। রাস্তার প্রতিবাদ। আরব দুনিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে মার্কিন দুনিয়া, সর্বত্র প্লাবন বইয়ে দিয়েছে এই রাস্তার প্রতিবাদ। তাতে কখনও রাজনীতি আছে, কখনও আবার স্পষ্ট কোনও রাজনীতি নেই। কোথাও হিংসা আছে, আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিংসা নেই। কিন্তু সর্বত্রই যেটা আছে-- জেদ, প্রতিজ্ঞা, দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়ার আত্মবিশ্বাস। কী ভাবে সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের প্রকৃতি, কী বিপুল হয়ে উঠতে পারে আন্দোলনের অবয়ব, দেখিয়ে দিয়েছে ছোট মাঝারি বড় কত রকমের দেশ: টিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, গ্রিস, রাশিয়া, এমনকী খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মাসের পর মাস ধরে চলেছে আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রাবল্য সহ্য করে। যতই লাঠিচার্জ হোক, গোলাগুলি চলুক, সরানো যায়নি সারিবদ্ধ সাধারণ মানুষকে, নিরস্ত্র কিন্তু সজেদ মুখে তাঁরা দাঁড়িয়ে থেকেছেন লাগাতার। অক্টোবরে নিউ ইয়র্কে শুরু হল অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, বাইরের পৃথিবী ভেবেছিল রাজনীতিহীন দিশাহীন আন্দোলন দু’দিনে মরে যাবে। প্রশাসন নভেম্বরে মেরেধরে ছত্রখান করে দিল জুকোটি পার্ক পাল্টা মার না মেরে জনতা ফিরে গেল, বলে গেল, ‘আবার আসব!’ এবং আবার এল তারা, ডিসেম্বরে, আবার উত্তাল হয়ে উঠল আন্দোলন।
আমরাও ফিরে আসব। পরবর্তী দুর্ঘটনা ঘটলে। তত দিন অপেক্ষায় থাকব। মোমবাতিগুলি হাতের কাছে রাখব। |