২৮ নম্বর প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। নাম ফোর্ট রয়্যাল। যে বহুতলটির নীচ তলায় কলকাতা পুরসভার ১০ নম্বর বরো অফিস। এবং যে অফিস বা সামগ্রিক ভাবে বহুতলটির বিরুদ্ধেই রয়েছে জাতীয় গৃহনির্মাণ নির্দেশিকা (এনবিসি) না মানার অভিযোগ। খোদ দমকলের তরফে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে হেতু বাড়িটিতে পুরসভার বরো অফিস, তাই এনবিসি-র তোয়াক্কা না করেই ওই বহুতলের একাংশ তৈরি হয়েছে। আরও অভিযোগ, সামগ্রিক ভাবে বহুতলটির ক্ষেত্রেও আগুন নেভানোর ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সন্তোষজনক নয়। অস্থায়ী ছাড়পত্রেই বাড়িটিতে একাধারে পুরসভার অফিস ও অন্য কাজ চলছে বলে দমকলের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন।
পুর-আইন অনুযায়ী শহরে ‘নিরাপদ’ বাড়ি তৈরিতে সওয়াল করেন কলকাতা পুর-কর্তৃপক্ষ। ছাড়পত্র দেওয়ার সময়ে এনবিসি-র পরামর্শ কে কতটা মেনে চলেছে, দমকলও তা খতিয়ে দেখে। কিন্তু পুরসভার নিজেদের বাড়ির ক্ষেত্রে কী ভাবে ওই সব আইন লঙ্ঘন করা হয়, তার উদাহরণ প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের বাড়িটি। অর্থাৎ, ভূত একেবারে সরষের ভিতরেই!
এনবিসি তৈরি হওয়ার ঢের আগে তৈরি শহরের পুরনো বাড়িগুলির ক্ষেত্রে এতটা সতর্কতা বজায় রাখার বাস্তব সমস্যা নিয়ে আকছার অভিযোগ তোলেন রাজ্যের দমকল বা পুর-কর্তারা। কিন্তু এই নতুন বাড়ির ক্ষেত্রে তা মানা হল না কেন? ২০০৭-এর এপ্রিলে পুরসভার ১০ নম্বর বরো-র অফিস-বাড়ির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। বছরের পর বছর সবেধন নীলমণি একটিমাত্র সিঁড়ি নিয়েই বাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে দমকলের অভিযোগ। বুধবার দুপুরে ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রের কাঠের খোপটা চোখে পড়ল। খোপই সার। ভিতরে আসল জিনিসটি নেই। তিন তলায় সিঁড়ির চাতালেই দু’-দু’টো গ্যাস সিলিন্ডার সাজিয়ে জমিয়ে চা-ডিম-টোস্ট রান্নার ধুম। ‘ফায়ার’ লেখা খোপটায় দেব-দেবীর ছবি শোভা পাচ্ছে। |
দমকলের এক ডেপুটি ডিরেক্টর বিভাস গুহের কথায়, “এনবিসি অনুযায়ী, যে-কোনও অফিস-বাড়িই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (হাই-রিস্ক)। সেখানে একটি সিঁড়ি স্বস্তিদায়ক নয়।” কিন্তু বাড়িটির ব্যাপারে পুরসভাকে একবারও সতর্ক করেনি দমকল।
কলকাতা পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) দেবাশিস করের অবশ্য দাবি, “পুরসভার অফিসে অবশ্যই দ্বিতীয় সিঁড়ির জায়গা আছে। বরোর এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের উচিত সিঁড়ির মুখটা পরিষ্কার করে দেওয়া।” কিন্তু ১০ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ওই অফিসের কর্মীরা কারওরই দ্বিতীয় সিঁড়ির অস্তিত্ব জানা নেই।
অমিতাভবাবু মানছেন, বাড়ির ভিতরে আগুন নেভানোর যন্ত্রও কবেকার কেউ জানে না। ধোঁয়া-জরিপ যন্ত্র থাকলেও তা কী ভাবে কাজ করে, জানা নেই। আগুন মোকাবিলায় মহড়ার রেওয়াজ নেই। পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক কর্তার কথায়, “বহুতলটির ক্ষেত্রে কিছু আইন মানায় খামতি আছে। জেনেও কিছু করা হয়নি।” দমকলের হয়ে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি যিনি দেখেন, ডেপুটি ডিরেক্টর দীপক সরকার ‘পুরসভার বাড়ির বিষয়ে কিছু বলব না’ বলে মন্তব্য এড়িয়েছেন। তবে দমকলের অন্য এক কর্তার কথায়, “পুর অফিস ছাড়াও গোটা বহুতলেই সতর্কতায় খামতি ছিল। ওয়েট-রাইজারের মাধ্যমে জল দেওয়ার ব্যবস্থা বা জল ছিটোনোর স্প্রিঙ্কলার ছিল না। বহুতলটিকে অস্থায়ী ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরে পুরসভা বা বেসরকারি নির্মাতারা ছাড়পত্র নেননি।”
পুরসভার অফিস থেকে বেরিয়ে মূল বহুতলটিতে ঢুকতে গেলে পথ আটকান নিরাপত্তারক্ষীরা। বাড়ির কেয়ার-টেকার শেখ লাল্টুর সঙ্গে তাঁরা কথা বলতে বললেও তিনি পরিচয়পত্র দেখার পরেও কিছু বলতে চাননি। যাঁর আমলে এই বাড়ির নকশা অনুমোদন পেয়েছিল, সেই মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বহুতলটিতে নিরাপত্তার সমস্যা থাকলে তা একা পুরসভার দায় নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “বিল্ডিং কমিটিতে তো দমকলের লোকেরাও থাকেন। কোনও ত্রুটি থাকলে, তখন ওঁরা কেন তা মেনে নিয়েছিলেন।” পরবর্তী মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বা বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও ওই বহুতল বা পুরসভার বরো অফিসের ‘বেনিয়মে’-র বিষয়টি ‘জানা নেই’ বলে মন্তব্য করেন। শোভনবাবু বলেন, “দমকল বাড়িটায় ত্রুটির কথা বললে তা দ্রুত শুধরে ফেলা হবে।” পুরসভা যদি নিজের বাড়ির ক্ষেত্রেই নিয়ম না মানে, তা হলে অন্যদের তা কী ভাবে মানানো যাবে, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠে গিয়েছে। |