অতিথিরা খাওয়াদাওয়া করছেন, নববধূ তখনও বসে রয়েছেন, আত্মীয়স্বজনেরা ঘিরে রয়েছেন তাঁকে। ফুলের গন্ধে, হাসির শব্দে চারিদিকে খুশির হাওয়া। হঠাৎই সে সব বদলে গেল আর্ত চিৎকারে। ছুটোছুটিতে। কোনওমতে নববধূ ও অন্যদের বাড়ি থেকে বার করে আনা হয়। বৌভাতের সেই রাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল বাড়ি ঘিরে।
আমরি কাণ্ডের সামান্য আগে কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের গা লাগোয়া একটি অনুষ্ঠান বাড়িতে সেই অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি ওই পরিবারের মনে এখনও জ্বলন্ত। তাঁরা মনে করতে পারেন, কী ভাবে ছাদ থেকে দু’টি গ্যাস সিলিন্ডার ছুঁড়ে দিয়েছিলেন খালের জলে। আর তার ফলেই সেই দিন বড় কোনও বিপদ ঘটেনি। কিন্তু দমকল দফতর জানিয়েছে, সিলিন্ডারগুলো ফেলে না দিলে, সেই দিন সত্যিই মারাত্মক কাণ্ড ঘটে যেতে পারত। দমকল জানিয়েছিল, শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, অনুষ্ঠান বাড়িগুলোর বিদ্যুতের ব্যবস্থার উপরে নজরদারি থাকবে না? কেন অনুষ্ঠান বাড়িতে সিলিন্ডার থাকবে? কেন অনুষ্ঠান বাড়িতেই রান্নাবান্না করা হবে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না রেখে, কেন বাড়ি থেকে বোরোনোর একাধিক পথ থাকবে না? কেন অনুষ্ঠান বাড়ির কাছাকাছি জলের ব্যবস্থা রাখা হবে না? কেন সে সব বাড়িতে থাকবে না অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র? |
কৃষ্ণনগরের মানুষ জানাচ্ছেন, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রায় সব অনুষ্ঠান বাড়িরই হাল এই রকমই। সেই ঘটনার পরেও শহরের অনুষ্ঠান বাড়িগুলোর মালিকেরা কিন্তু বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু অনুষ্ঠানবাড়িগুলোর চরিত্র এমনই যে, সেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য খুব অল্প জায়গায় কয়েকশো মানুষ জড়ো হন। তাঁদের মধ্যে খুব কম জনই বাড়িটিকে ভাল করে চেনেন। বাড়ির কোন ঘরে কী রয়েছে, তা জানেন গুটি কয়েক লোক। এমনকী কোথায় বিদ্যুতের ‘মেন সুইচ’, সে কথাও আমন্ত্রিতদের জানার কথা নয়। তার মধ্যেই চলে অবাধে সিগারেট খাওয়া এবং গ্যাসে রান্না। এই ধরনের বাড়িতে নিয়মিত কেউ বসবাস করেন না বলে, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে ছোটখাট ত্রুটি ঘটে গেলে, তা নজর এড়িয়ে যেতে পারে। সেই ছোট্ট ত্রুটি থেকেই কোনওদিন বড় কোনও বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। শহরের একটি লজ মালিক দেবাশিস সাহা বলেন, “সরাই রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি। তাই সংশ্লিষ্ট দফতরই দমকলে দিয়ে তদন্ত করাবে।” তিনি বলেন, “আমরির ঘটনার পরে আমরা কিন্তু বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আমার লজে রান্না করতে হয় ফাঁকা জায়গায়। দু’টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও রয়েছে।” আর এক লজ মালিক গৌতম দাস বলেন, “সত্যি বলতে কী, এতদিন আমাদের কেউ কিছু বলেননি। আর তা ছাড়া দমকলের লাইসেন্স কলকাতা থেকে করিয়ে আনতে হয়। তাতে নানা সমস্যা হয়। তাই কেউই সেটা করতে চাইতেন না। তবে এ বার ব্যবস্থা করতেই হবে।” নদিয়া জেলা লজ-হোটেল মালিকদের সংগঠনের সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা বরাবরই সদস্যদের সতর্ক করে আসছি। যাঁরা এখনও দমকলের ছাড়পত্র সংগ্রহ করেননি বা আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখেননি, তাঁরা যাতে দ্রুত তা করে ফেলেন, সে ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।”
শহরে পুরসভার নিজেরও কয়েকটি অনুষ্ঠানবাড়ি রয়েছে। দমকল সূত্র জানিয়েছে, সেই বাড়িগুলোরও দমকলের অনুমতি নেই। নেই প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। লালদিঘির পাশের অনুষ্ঠান বাড়িতে একটি মাত্র সিঁড়ি। রান্না হয় বাড়ির ভিতরেই। কোনওটাতেই গ্যাস বা আগুন অ্যালার্ম নেই। পুরপ্রধান অসীম সাহা বলেন, “লজগুলিতে আমরা পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা রেখেছি। আর লালদিঘির পাশের লজটি অনেক আগে তৈরি। তবে এখন আমরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। লজগুলো ঢেলে সাজা হবে।” তাঁর কথায়, “লজগুলোর দমকলের অনুমতি থাকা বাধ্যতামূলক। যারা তা করবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |