আগে মেলা হত ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রবেশ মূল্য ছিল পাঁচ টাকা। সেই মেলা দু’মাস এগিয়ে আনা হল। প্রবেশ মূল্যও তুলে দেওয়া হল। আর তাতেই বাজিমাত।
এই প্রথম হাসিমুখে কলকাতার হস্তশিল্প মেলা থেকে বাড়ি ফিরে গেলেন পশ্চিম মেদিনীপুর সবংয়ের মাদুর শিল্পী মৌমিতা মাইতি, নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মৃৎশিল্পী প্রদীপ পালেরা। শিল্পীরা লাভ করায় উৎসাহিত রাজ্য সরকারও। রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “গত বার হস্তশিল্প মেলায় লোক হয়েছিল সাড়ে ৩ লক্ষ। এ বার হয়েছে সাড়ে ৮ লক্ষ। লোক বেশি হওয়ায় কেনাকাটাও বেড়েছে।” সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত বার মেলায় যেখানে ৮ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছিল, এ বার সেখানে বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। বিক্রি বেড়েছে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। শিল্পীদের বক্তব্য, বহু দিন পরে এত লাভ হল।
বিগত বছরে কলকাতায় রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় এসে তেমন লাভ করতে না-পেরে প্রায় কেঁদে বাড়ি ফিরতেন বিভিন্ন জেলার হস্তশিল্পীরা। এমনকী, জিনিস বিক্রি করতে না-পেরে শেষ দিনে মেলার মাঠেই নিজের শিল্পকর্ম ভেঙে ফেলে চলে যেতেন শিল্পীরা। আর শনিবার, মিলন মেলার মাঠ থেকে এ বারের মেলা শেষে তাঁরাই বাড়ি ফিরে গেলেন হাসিমুখে। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের পাটশিল্পী কণ্ঠ খানের মতো অনেকেই বললেন, “দু’হাজার পাটের পুতুল আর প্রচুর পাটের কার্পেট বিক্রি হয়েছে। এই প্রথম কলকাতার মেলায় এ ভাবে সব বিক্রি হয়ে গেল।”
তাঁর মতো বেশির ভাগ শিল্পীরই কোনও শিল্পকর্ম পড়ে থাকেনি। লাভ হয়েছে ভালই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পূজালি থেকে মাটি, ফাইবারের পুতুল, আসবাবপত্র নিয়ে পসরা সাজিয়েছিলেন কানু দাস। তিনি বলেন, “গত বারের চেয়ে দেড় লক্ষ টাকা লাভ হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি কেনাকাটা বেড়েছে।”
উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের হস্তশিল্পী রথীন কর্মকার বলেন, ‘‘এক যুগ পরে এই প্রথম মেলায় এত লাভ করলাম। আগে বইমেলা-সহ বিভিন্ন মেলা শেষ হওয়ার পরে ফেব্রুয়ারিতে এই মেলা হত। শীত চলে গিয়ে গরম চলে আসত। মেলা এগিয়ে আনার জন্য অনেকবার আবেদন করেছি। কিন্তু কেউ কানে নেয়নি।” শেষদিনে টেরাকোটার ল্যাম্প আর নেই বলে ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন বনগাঁর নান্টু পাল। তিনি বলেন, “এ বার এটাই কলকাতার প্রথম মেলা। সবাই তাই হাত খুলে কিনেছে।”
বর্ধমানের কাটোয়ার কাঠের পুতুল শিল্পী টোটন সূত্রধর বলেন, “মহাজনের কাছে পুতুল বেচে লাভ থাকে না। তাই এ রকম মেলায় ছুটে আসি। হস্তশিল্পীদের সবাই তো আর কদর করে না। এমন মেলার সংখ্যা আরও বাড়লে দু’বেলা খাবারটুকু জুটে যাবে।” এ প্রসঙ্গে মানসবাবু বলেন, “শিল্পীরা লাভ করায় আমরা উৎসাহিত। ১৯ ডিসেম্বর উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুর এবং তার পরে মালদহ, বর্ধমান ও অন্যত্রও এই শিল্পীদের নিয়ে মেলা করব। শিল্পীদের পরিচয়পত্র, বিমা, ২ লক্ষ টাকা করে ঋণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।”
গত বার মেলা ছিল ২৪ দিনের। এ বার তা কমিয়ে করা হয় ২১ দিন। ২৯৮৩টি স্টলে রয়েছেন সাড়ে তিন হাজারের মতো শিল্পী। গত বছরেও কেউ স্টলে, কেউ বা মাটিতেই নিজের কীর্তি নিয়ে বসেছিলেন ক্রেতার আশায়। আর এ বার শেষ দিন, শনিবারেও রাত ১০টা পর্যন্ত ছিল বেশ ভিড়। কলকাতার গড়িয়া থেকে মেলায় সপরিবার এসেছেন সুদীপ্তা রায়। ছোট-বড় সবার দু’হাত ভর্তি ডোকরা, বাঁশ, সুতো পাট, বেতের রকমারি জিনিসে। সুদীপ্তা বলেন, “গত বারও আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেদিনই আসব ভাবি, সেদিনই বৃষ্টি। মেলাটা তো এই হালকা শীতেই ভাল লাগে। অসাধারণ মেলা। মুড না হলে মেলায় ঘোরা, কেনাকাটা করা যায়?” |