অনুমতি রয়েছে পাঁচটি শয্যার। কালনা মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক সুভাষচন্দ্র মণ্ডল এক-দুই করে গুনে দেখলেন, রয়েছে এগারোটি।
সুভাষবাবুর প্রশ্ন, “কেন এতগুলো বাড়তি শয্যা?” উত্তর এড়িয়ে গিয়ে নার্সিংহোম কর্তার সহাস্য জবাব, “রোগী-টোগি তো বিশেষ হয় না। এগুলো খালিই পড়ে থাকে।” “নার্সিংহোম থেকে বেরনোর পথ কই? অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডারও একেবারে ভিতরে একটি ঘরে রাখা?” জানতে চান সুভাষবাবু। মাথা চুলকে কর্তা বলেন, “ভিতরের দিক দিয়ে আরও একটি দরজা আছে, স্যার। দরকার পড়লে ওঠা খুলে দেব। আর আপনি চাইলে কালই আরও দু’টো সিলিন্ডার সামনে এনে রেখে দেব।”
কাছাকাছি একটি দোতলা নার্সিংহোমে একতলায় অফিসঘর ছাড়াও রয়েছে রোগীর শয্যা। চত্বরের মধ্যেই জেনারেটরের ঘর। তার কাছেই ডাঁই হয়ে আছে খালি স্যালাইনের বোতল আর নানা আবর্জনা। অন্য পাশে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার। এখানে গ্যাস জ্বালানো হয়? কর্তৃপক্ষের সাফাই, “রোগীদের জন্যই গরম জল-টল করে দিতে হয়।”
আচমকা ‘অভিযান’ নয়। তাঁরা যে কালনা শহরে ‘পরিদর্শনে’ যাবেন, নার্সিংহোম অ্যাসোসিয়েশনকে তা সকালেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক। তা সত্ত্বেও নার্সিংহোমগুলি যে ঘর গোছাতে পারেনি, সোমবার দুপুরে তা প্রতি পদে বেরিয়ে আসতে থাকে। সুভাষবাবুর সঙ্গে ছিলেন কালনা পুরসভার কর্মাধ্যক্ষ (জঞ্জাল) গোকুলচন্দ্র বাইন এবং সিনিয়র ইনস্পেক্টর নীতিন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমেই সাহু সরকার মোড়ে একটি নার্সিংহোমে গিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের শংসাপত্র চেয়েও পাননি তাঁরা। দেখা যায়নি একটিও অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডার।
|
গ্যাস সিলিন্ডার অবাধেই। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র। |
সেখান থেকে কয়েক পা এগোলেই রাস্তার গা ঘেঁষে শহরের সবচেয়ে পুরনো নার্সিংহোম। অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডার থাকলেও দোতলায় ওঠার সিঁড়ি খুবই সরু। কয়েকটি ঘরে এখানে-ওখানে খসে গিয়েছে পলেস্তারা। “কেন এই দুরবস্থা?” প্রশ্ন সুভাষবাবুর। উত্তর আসে, “নার্সিংহোমের জায়গা নিয়ে দশ বছর ধরে মামলা চলছে। আমরা রেন্ট কনট্রোলে ভাড়া দিই। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পরিকাঠামোর উন্নতি করা যাচ্ছে না।”
এ দিন যে ছ’টি নার্সিংহোমে পরিদর্শন করা হয়, তার প্রতিটিতেই নিয়ম ভেঙে বাড়তি শয্যা রাখা হয়েছে। গোকুলবাবুর মতে, “শয্যাসংখ্যা গোপন করে পুরসভাকে ঠকানো হচ্ছে। এদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর হওয়া দরকার।” বৈদ্যপুর মোড়ে নার্সিংহোম অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মিহির কোনারের নিজের নার্সিংহোমেও দেখা গিয়েছে বাড়তি শয্যা। তবে তাঁর দাবি, “শয্যা বেশি থাকলে কী হবে? যত রোগী রাখার অনুমতি আছে, ততই রাখা হয়।” সে ক্ষেত্রে, বাড়তি শয্যা রাখার কী দরকার, তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য মেলেনি।
লক্ষণীয়, ছ’টি নার্সিংহোমের একটিতেও দেখা মেলেনি কোনও চিকিৎসকের। তার বদলে সর্বত্র মিলেছে ধরাবাঁধা উত্তর, “ডাক্তারবাবু একটু আগেই বেরিয়ে গেলেন।” ২৪ ঘণ্টা এক জন চিকিৎসকের থাকার কথা। কিন্তু এমন কোনও ডাক্তারের নাম বলতেও ঢোঁক গিলেছে কোনও কোনও নার্সিংহোম। এ রকম নানা বেনিয়ম প্রসঙ্গে মিহিরবাবুর কৈফিয়ত, “এ শহরে নার্সিংহোম ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। মাঝে-মধ্যেই নানা কারণে রোগীর আত্মীয়েরা হামলা চালাচ্ছে। তবে নিজেদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করব।”
সুভাষবাবুর আশ্বাস, “দু’টি নার্সিংহোমের ব্যাপারে কড়া রিপোর্ট পাঠাব জেলায়। বাকি চারটিকেও কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করা হবে। মঙ্গলবার ফের চারটি নার্সিংহোম ঘুরে দেখব আমরা।” কিন্তু নার্সিংহোম কর্তাদের আগাম খবর দিয়ে এ কেমন পরিদর্শন? সুভাষবাবুর বক্তব্য, “ওরা যাতে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে পারে, তার জন্যই আগে জানানো হয়েছিল। যাতে সময় কম নষ্ট হয়।”
তড়িঘড়ি দায়সারা ‘পরিদর্শন’ না জুয়াচুরি ধরতে আচমকা ‘অভিযান’, কোনটা প্রশাসনের করণীয় সে প্রশ্ন অবশ্য উঠছেই। |