আমরি কাণ্ডের পরে বীরভূমের জেলা হাসপাতাল থেকে মহকুমা হাসপাতালের অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা বেআব্রু হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা জেলার নার্সিংহোমগুলিরও। রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে খোদ অপারেশন থিয়েটারের ভিতরেই বিদ্যুৎবাহী খোলা তার দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী থেকে রোগীর আত্মীয়েরাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, সিউড়ি সদর হাসপাতাল থেকে রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতাল- কোথাও ‘ফায়ার লাইসেন্স’ নেই। ব্যাতিক্রম বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল। সিউড়ি হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নামমাত্র। বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণের কয়েকটি সিলিন্ডার থাকলেও তা ব্যবহার করার জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ নেই। সব থেকে শোচনীয় অবস্থা রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের। এখানে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কার্যত নেই। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক আশিষকুমার মল্লিক বলেন, “সরকারি হাসপাতালগুলির ফায়ার লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে আমরি কাণ্ডের পরে এ বার হাসপাতালগুলির আগুন নেভানোর পরিকাঠামো গড়ে তোলায় জোর দেওয়া হয়েছে।” তিনি জানান, শীঘ্রই দমকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।”
ফায়ার লাইসেন্স না থাকলেও হাসপাতালগুলিতে যেখানে কয়েকশো করে রোগী ভর্তি থাকেন, সে ক্ষেত্রে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা থাকা যে জরুরি তা জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা স্বীকার করেছেন। দমকলের এক আধিকারিক জানান, হাসপাতালগুলিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ভর্তি সিলিন্ডার, ড্রাই পাইডার, ফোম-ইত্যাদি আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখা খুবই জরুরি।
|
সিউড়ি হাসপাতালে সুপারের অফিসের বারান্দায় পড়ে রয়েছে কাগজ। তার পাশে
টেবিলে হিটার জ্বালিয়ে রোজই চা তৈরি হয়। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
একই সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে ওই সব সরঞ্জাম ব্যবহার করার জন্য হাসপাতালে প্রশিক্ষিত কর্মী রাখা উচিত। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য। সিউড়ি সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গিয়েছে রান্নাঘরে ও প্রসূতি বিভাগ ছাড়া আর কোথাও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। অপারেশন থিয়েটারেও নেই। নেই ফায়ার অ্যালার্ম। বালি ও জল ভর্তি বালতি দেখা যায়নি। হাসপাতাল সুপার মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “কয়েকটি মাত্র জায়গায় অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। কর্মীদের আগুন নেভানোর কাজে প্রশিক্ষণ নেই।” তিনি জানান, হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপনের পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি জেলা মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। সিউড়ি দমকল কেন্দ্রের আধিকারিক জয়দেব ঘোষাল বলেন, “অগ্নিনির্বাপণ বিধি মানা হচ্ছে কি না তা নিয়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় শীঘ্রই পরিদর্শনে যাওয়া হবে।”
২৮৬ শয্যার রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। অর্ন্তর্বিভাগ থেকে বর্হির্বিভাগ- এমনকি রান্নাঘরেও আগুন নেভানোর জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড ভর্তি সিলিন্ডার নেই। কয়লা গিয়েই রান্নার কাজ চলে। বালি বা জল ভর্তি বালতিও নেই। অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বিদ্যুতের স্যুইচ বোর্ড খোলা। বিপজ্জনক ভাবে তার বেরিয়ে রয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর কাঠের বক্সও খোলা পড়ে রয়েছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, অপারেশন থিয়েটারে অনেক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। ওই সব দাহ্য পদার্থে আগুনের ফুলকি পড়লে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। অথচ স্বাস্থ্য দফতর থেকে মাস দু’য়েক আগে পাঠানো অগ্নিনির্বাপণের কয়েকটি সিলিন্ডার এখন বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাখতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্টোররুমেই সে সব ফেলে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রি হালদার এ কথা স্বীকার করে বলেন, “স্বাস্থ্য দফতর দু’ মাস আগে কয়েকটি সিলিন্ডার পাঠিয়েছে। সেগুলি খুব শীঘ্রই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখা হবে।” তবে সেই সিলিন্ডার এলেও তা ব্যবহার করার পদ্ধতি কর্মীরা জানেন না। ফলে আশঙ্কা কাটছে না। বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ছবিটা তুলনামূলক ভাল। এখানে কয়েকটি ওয়ার্ডে আগুন নেভানোর ১০টি সিলিন্ডার দেখতে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত কর্মী নেই। হাসপাতাল সুপার সুদীপ মণ্ডল বলেন, “দমকল বিভাগের কর্মীরা এক বার ওই সিলিন্ডারগুলি ব্যবহার করা নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে আগুন লাগলে কর্মীরা তা মোকাবিলা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।”
অন্য দিকে, জেলার অধিকাংশ নার্সিংহোম ফায়ার লাইসেন্স নেয়নি বলে দমকলের অভিযোগ। দমকলের এক আধিকারিক বলেন, “বেশিরভাগ নার্সিংহোমগুলি ফায়ার লাইসেন্স নেয়নি। অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাও ঠিকঠাক নেই। এ ভাবে নার্সিংহোম চলা মানে তো রোগীদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা চলছে।” দু’জন নার্সিংহোম মালিক অশোক চট্টোপাধ্যায় ও নীলরতম দত্ত বলেন, “আগুনের মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো শীঘ্রই গড়ে তোলা হবে।” বাসিন্দাদের বক্তব্য, আমরি-র ঘটনা থেকে হাসপাতাল, নার্সিংহোম ও স্বাস্থ্য দফতর শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে ভাল। তা নাহলে ফের আমরি-র পুনরাবৃত্তি ঘটলে আফশোস ছাড়া আর কিছু থাকবে না। |