উডল্যান্ডস-ফর্টিস পরিদর্শন
অগ্নিবিধি না মেনেও মেলে ছাড়, কাঠগড়ায় দমকলও
মনটা যে হবেই তা তাঁরা বোধহয় জানতেন। তাই সোমবার কলকাতার দু’টি বেসরকারি হাসপাতালের অগ্নিবিধি খতিয়ে দেখতে গিয়ে মোটেই বিস্মিত হলেন না দমকলের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সদস্যেরা। তাঁরা দেখলেন, আমরির মতো ওই দুই হাসপাতালের ক্ষেত্রেও অগ্নিবিধি না মানার কোনও শাস্তি হয়নি। বরং বছর বছর শর্তসাপেক্ষে দমকলের অস্থায়ী ছাড়পত্র পেয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে।
এ দিনের পরিদর্শনে দেখা গেল, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল কোনও ব্যতিক্রম নয়। আলিপুরের উডল্যান্ডস হাসপাতাল আর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ফর্টিস হাসপাতালে এ দিন গিয়েছিল দমকল। আর দু’টি ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার অ-আ-ক-খ মেনে চলায় অনীহার বিষয়টি ধরা পড়েছে। তা সত্ত্বেও কেন হাসপাতালগুলি এখনও বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্নে দমকল-কর্তারা চুপ। এ ছাড়া, হাসপাতালগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যাপারে যে সব গলদ পাওয়া গিয়েছে, তা তাদের নিয়মিত নজরদারি থাকলে যে কখনওই হওয়া সম্ভব ছিল না তা স্বীকার করেছেন দমকল বাহিনীর কর্তাদের অনেকেই। তাঁদের মতে, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষগুলোর মতো সমান দায়ী দমকলও। আমরি-কাণ্ডের তদন্তে নেমে কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশও দমকলের লাইসেন্স নবীকরণ ঠিক ভাবে হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে।
নন্দরাম মার্কেটের আগুনের পরে দমকলকে আঁটঘাট বেঁধে শহরের সাবেক বাণিজ্যিক এলাকা বড়বাজার-পোস্তায় পুরনো বাড়ি পরিদর্শনে নামতে দেখা গিয়েছিল। আবার স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে দমকল-পুরসভা-পুলিশ-সিইএসসি-র সমন্বয় কমিটি গড়ে বেছে বেছে পুরনো বাজার এবং বহুতলের হাল-হকিকত পরিদর্শন শুরু হয়েছিল। সেই পরিদর্শনের পরে সংশ্লিষ্ট বাজার এবং ভবনগুলিকে বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যাপারে নির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল কমিটি। কিন্তু ৯০ শতাংশ বাড়ি বা বাজার তা মানেনি। যারা মানেনি তাদের শাস্তিও হয়নি। তাই এ বার দমকলের হাসপাতাল পরিদর্শনে কোনও লাভ আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে পরিদর্শনের প্রথম দিনেই।
চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
এ দিনের পরিদর্শনে কী কী ত্রুটি পাওয়া গেল দুই বেসরকারি হাসপাতালে?
দমকল কর্তারাই বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে বছর-বছর অস্থায়ী ছাড়পত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে উডল্যান্ডসে। কিন্তু এত দিনেও ধোঁয়া-সঙ্কেত যন্ত্র (স্মোক ডিটেক্টর) বা বিপদ-ঘণ্টি (ফায়ার-অ্যালার্ম) চালু করা যায়নি। মজুত নেই মাটির নীচের জলাধার (হাইড্র্যান্ট)। আগুন জ্বলতেই জল ছিটোনোর স্বয়ংক্রিয় স্প্রিংকলারেরও চিহ্ন নেই। ভবনটির চারপাশে দমকলের গাড়ি ঢোকার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। দরকারে হাসপাতাল-চত্বরে গাছ ছাঁটতে হবে। এমনকী, হাসপাতালের সুদৃশ্য গাড়ি-বারান্দাটির জন্য জানলায় মই লাগাতে সমস্যা হতে পারে বলে দমকলের দাবি। তিনটি বেসমেন্টে বাড়ির নানা জরুরি সরঞ্জাম এবং নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের পোশাক বদলানোর জায়গা নিয়েও দমকল আপত্তি তুলেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, ১০-১২ দিন আগেই আগুন নেভানোর ব্যবস্থার কাজ শুরু হয়েছে। পরের বছরের গোড়ায় দমকলের ছাড়পত্র পুনর্নবীকরণের সময়ের আগেই তা শেষও হয়ে যাবে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনও কোনও রোগীর অবশ্য দাবি, আমরির ঘটনার পরেই হাসপাতালে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজার কাজ শুরু হয়েছে।
তবে উডল্যান্ডসের বাড়িটি ১৯৫৮ সালের। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বা জাতীয় বহুতল বিধি অনুসারে এ রাজ্যে দমকল আইন চালু হওয়ার ঢের আগে বাড়িটি তৈরি। তবুও কোনও বিপদে হাসপাতাল থেকে রোগীদের বের করার ব্যবস্থায় দমকল কর্তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, অনেকগুলি সিঁড়ি ও দরজা আছে। একটি সিঁড়ি বেশ প্রশস্ত। উডল্যান্ডসের মূল ভবন এবং সংযুক্ত ভবন জুড়ে দু’-তিনটি খোলা ছাদও রয়েছে, হাসপাতালের তিন এবং চার তলায়। দমকলের এডিজি-র পরামর্শ: “এই ছাদগুলিকে বিপদের সময়ে রোগীদের আশ্রয় দেওয়ার কাজে ব্যবহার করুন। রোগীদের বের করতে এই ছাদগুলির সঙ্গে যুক্ত ঢাল বা র্যাম্প গড়া সম্ভব কি না, তাও খতিয়ে দেখুন।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, দমকল কাজ শেষের কোনও মেয়াদ বলেনি। মৌখিক সুপারিশের পরে লিখিত সুপারিশও পাঠানো হবে বলে দমকল জানিয়েছে।
ফর্টিস হাসপাতালের নির্মাণ ১৯৯৯ সালে। এ বাড়িটির অবস্থাও পুরোপুরি ‘স্বস্তিদায়ক’ নয়। দমকল কর্তাদের পর্যবেক্ষণ, এ বাড়িটিতে জায়গা অত্যন্ত কম। কাঠের পার্টিশন দেওয়া গুচ্ছের খোপ। সিঁড়ি যথেষ্ট চওড়া নয়। আইটিইউ-এর উপরে সিঁড়িতে ডাঁই করা কাগজপত্র। জলাধার, বিপদ-ঘণ্টি, স্মোক-ডিটেক্টর থাকলেও সব জায়গায় স্প্রিংকলার নেই। দমকলকর্তারা মানছেন, এখানেও হাসপাতাল চলছে অস্থায়ী ছাড়পত্রের ভিত্তিতে। একতলায় রান্নাঘর থেকে বিপদ এড়াতে দমকলের তরফে বাড়ির বাইরে ‘গ্যাস-ব্যাঙ্ক’ তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, তিন বছর আগে হাসপাতালটির মালিকানা বদলের পরে এখন চলছে বাড়িটির সার্বিক সংস্কার। তাতে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা থেকে আগুন নেভানোর কৃৎকৌশল— সবই ঢেলে সাজা চলছে। আমরির ঘটনায় ‘শিক্ষা’ নিয়ে দমকল কর্তারা কিন্তু প্রশ্ন তুলছেন, “এই সংস্কার-পর্ব চলতে চলতে যদি দুর্ঘটনা ঘটে তখন কী হবে?”
পরিদর্শক কমিটির প্রধান, দমকলের অতিরিক্ত ডিজি দেবপ্রিয় বিশ্বাস বলেন, “দু’টি হাসপাতালের বিষয়ে সুপারিশই দমকল বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হবে। এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।” দেবপ্রিয়বাবু জানান, হাসপাতালের পরে কিছু শপিংমল বা হোটেলেও যাওয়া হবে।
কিন্তু দমকলের পরামর্শ ওই সব সংস্থা না মানলে তাদের কোনও শাস্তি হবে কি? সে ব্যাপারে এক দমকল-কর্তার মন্তব্য, “সব রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা পড়বে। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।” পরিদর্শক-দলে ছিলেন দমকলের প্রাক্তন অধিকর্তা বরেন সেন এবং ব্রিটেনের ইনস্টিটিউট অব ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফেলো-মেম্বার শেখর দে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.