মা বলত, “আমাদের অভাবের সংসার। ধিঙ্গি মেয়ের মতো দৌড়ে কী করবি? তার থেকে বাড়ির কাজে হাত লাগা।” মেয়ে বলত, “মা, আমাকে দৌড়তে দাও। দেখো, এক দিন ঠিক তোমাদের খাওয়ার জোগাড় করে আনব আমি।”
হাসনাবাদের বিশপুর পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম বাইলানির ছোট্ট মেয়ে সুপ্রিয়া মুণ্ডার এমন আবদার রাখা মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই খেলাধূলা নিয়ে মেয়েকে বকাবকি, মারধর করতেন। কিন্তু মেয়ের তো দু’চোখে স্বপ্ন। চতুর্থ শ্রেণির সুপ্রিয়া ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত, ব্লক, মহকুমা এমনকী জেলা স্তরেও একশো-দু’শো মিটার দৌড়ে বহু খেতাব পেয়েছে। সেই সব শংসাপত্র, মেডেল ব্যাগে করে রবিবার সকালে সে বেরিয়ে পড়েছিল কলকাতার দিকে। শুনেছিল, সেখানে নাকি অনেক সুযোগ। খেলতে পারবে। পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারবে। সুন্দরবনের হদ্দ গ্রাম তার স্বপ্নপূরণে অন্তরায়, সে কথাটি বিলক্ষণ বুঝেছিল এই বয়সেই।
সঙ্গীও জুটে গিয়েছিল, গ্রামেরই মেয়ে মামনি সর্দার। একই রকম হাঁড়ির হাল তাদের সংসারেও। মামনি পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। বাড়িতে বাবা-দাদা মারধর করেছিল। সেই অভিমানে বাড়ি ছাড়ার কথা ভাবে সে। শুনেছিল তার এক দাদু থাকে ‘কলকাতার কাছে’ সোনাখালিতে। সেই বাড়ি খুঁজতেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ে। |
স্কুলের জামাকাপড় পড়ে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে ইউনিফর্ম বদলে নেয় দু’জন। রবিবার সকালে হাসনাবাদ স্টেশন থেকে ওঠে পড়ে শিয়ালদহের ট্রেনে। পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নেমে গাঁয়ের দুই কন্যের তো চক্ষু চড়কগাছ। এত লোক, এত আলো, এত হইচই। ঘাবড়ে যায়। কী করবে, কোথায় যাবে! হাবভাব দেখে সন্দেহ হয় এক ‘কাকু’র। তিনিই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টিকিট কেটে দু’জনকে ফের হাসনাবাদের ট্রেনে তুলে দেন।
সেখানে আলাপ হয় এক ‘কাকিমা’র সঙ্গে। তিনিও বুঝেছিলেন, মেয়ে দু’টি বাড়ি থেকে পালিয়েছে। রবিবার বিকেলের দিকে বসিরহাটের কাছে মালতিপুর স্টেশনে তিনি মেয়ে দু’টিকে নিয়ে নেমে পড়েন। খোলাপোতাগামী অটোতে তুলে দেন। বলেন, সোজা বাড়ি চলে যাবি। অটোর ভাড়াও দিয়ে দেন। খোলাপোতা পৌঁছে ভ্যানে ওঠে দুই কন্যা। চালক হারাধন বিশ্বাসও বুঝে যান মেয়ে দু’টি পথ হারিয়েছে। তাদের নিয়ে তিনি সোজা চলে আসেন নিজের ঝুপড়িতে। খবর দেন লোকজনকে। খবর যায় পুলিশের কাছেও। সুপ্রিয়ার ব্যাগে একটি মোবাইল ফোন ছিল। তাতে যোগাযোগ করেন মা রিনাদেবী। কথা হয় হারাধনবাবুর সঙ্গে। সোমবার বসিরহাট থানায় এসে সুপ্রিয়া-মামনিকে নিয়ে যান বাড়ির লোকজন।
সুপ্রিয়া ব্যাগ থেকে বের করে দেখায় বেশ কিছু শংসাপত্র। যা সে নানা সময়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় পেয়েছে। কিছু মেডেলও আছে। গ্রামের এক ভদ্রলোক ক’দিন আগে খামে করে তিনশো টাকা দিয়েছিলেন তার দৌড় দেখে খুশি হয়ে। টাকাটা নিয়ে নিয়েছিলেন সুপ্রিয়ার মা। ভদ্রলোকের নাম লেখা সাদা খামটাই ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিল ছোট্ট মেয়েটি। তার কথায়, “কলকাতায় গিয়ে সকলকে বলতাম আমি খেলাধূলা করি। কেউ যদি বিশ্বাস না করে, সে জন্যই সব জিনিস নিয়ে বেরিয়েছিলাম।”
রিনাদেবী জানালেন, স্বামী বহু দিন আগেই কেরল চলে গিয়েছেন কাজের খোঁজে। মাঝে মধ্যে সামান্য যে ক’টা টাকা পাঠান, তা দিয়েই দুই মেয়ে, এক ছেলেকে নিয়ে সংসার চলে কি চলে না। সুপ্রিয়া মেজো। তার বাড়ির কাজে মন নেই। সুযোগ পেলেই হাঁ করে টিভি দেখে। না হলে একা একাই মাঠে দৌড়য়। অসহায় মা বলেন, “আমি ওকে বলি, এ ভাবে দৌড়ে কী করবি? কেউ খেতে দেবে না। তার থেকে সংসারে দু’টো একটা কাজ শেখ। গরিবের ঘরে এত স্বপ্ন দেখা ভাল নয়।”
আর সুপ্রিয়া বলে, “বড় হয়ে রানার হতে চাই। তাই সব সময় প্র্যাকটিস করি। বাড়িতে তো খুব অভাব। মা তাই বারণ করে। বলে, বাড়ির কাজ কর। বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু আমি দৌড়তেই চাই।”
বসিরহাটের মহকুমাশাসক অনামিকা মজুমদার বলেন, “আমাদের জানালে মেয়েটি যাতে খেলাধূলা চালিয়ে যেতে পারে, তা অবশ্যই দেখা হবে।” মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সভাপতি অমিত মজুমদার বলেন, “আমরা ওকে খেলার সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করব। রাজ্য ভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কিংবা তারও উপরে যদি ও যেতে যায়, আমরা আর্থিক সাহায্য করব।”
বিশপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সবিতা পাত্র বলেন, “গ্রামের মেয়েটি খেলাধূলা করত জানি। কিন্তু সে যে এত পুরষ্কার পেয়েছে, এতটাই মনের জোর, তা জানা ছিল না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ওদের আর্থিক সাহায্য করব।”
গণ্ডগ্রামের সুপ্রিয়ার স্বপ্নের দৌড় তাকে কোন লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। |