প্রবন্ধ ২...
শোক, শোক, শোক
কলকাতার রাগ হয় না?
শোক। শোক। শোক। খালি শোক। আর ভাল লাগছে না। অমুকে ‘শোকদিবস’ পালন করতে বলছে। তমুকে শোকে মাথা নত করতে বলছে। পোস্টার মারছে: ‘আমরা গভীর শোকাহত’। কেউ ফুল রাখছে হাসপাতালের গেটে। কেউ সহমর্মিতা দেখাচ্ছে। কেউ নীরবতা পালন করছে। কেউ মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। কেউ দার্শনিক হচ্ছে: লাইফ গো’জ অন। জীবন তো চলতেই থাকে।
কলকাতার রাগ হয় না!
শুক্রবার সকাল থেকে দু’দফায় কয়েক ঘন্টা করে এ এম আর আই চত্বরে কাটানো-সময়ে দেখা সেই মুখগুলো ফিরে ফিরে আসছে নিরন্তর। বিভ্রান্ত, শঙ্কিত, উদভ্রান্ত, ক্রুদ্ধ এবং দিশেহারা সব মুখ। পেশাদার সাংবাদিকের কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছেন অসহায় আর্তি নিয়ে কিছু করুন! কিছু একটা করুন! দোষীরা যেন ধরা পড়ে! যেন ছাড়া না-পায়! তাঁদের চোখের সামনে কপিকল বেয়ে নেমে আসছে একের পর এক প্রাণহীন দেহ। এই শহর, এই সমাজের বাসিন্দা তাঁরা। আমাদের সহনাগরিক। কয়েক ঘন্টা আগে অসুস্থ কিন্তু জীবন্ত মানুষেরা। যাঁরা চোখের সামনে একে একে ‘লাশ’ হয়ে গেলেন! যাঁরা কিছুক্ষণ আগেও মোবাইলে বলছিলেন, শ্বাস নিতে পারছেন না। ঘরে ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত ধোঁয়া। বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে-থাকা পরিজনেরা যাঁদের তখনও প্রবোধ দিচ্ছিলেন, আর চিন্তা নেই। আমরা এসে গিয়েছি।
দিন গড়িয়ে গেল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আছড়ে পড়ছিল একের পর এক ঢেউ। দেশবিদেশ থেকে। নিহতদের (মৃত নয়, নিহত যাঁদের মেরে ফেলা হল) আত্মার শান্তি কামনায়। পাশে থাকার ইলেকট্রনিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কারও লেখায় নিষ্ফল আক্রোশ। কেউ বলছেন, গণহত্যা! কারও লেখায় আপাত-পলায়নী ভাব, ভাগ্যিস বিদেশে আছি! আর ফিরব না বাবা ওই শহরে।
এই শহর, এই সমাজের বাসিন্দা তাঁরাও। আমাদের সহনাগরিক।
তাঁরা কী লিখছেন? হতাশ হয়ে লিখছেন, ওদের কিস্যু হবে না। কয়েক দিন পরেই রেহাই পেয়ে যাবে। তার পর পাঁচতারায় জমিয়ে ডিনার করবে। এখানে কিছু হয় না। হয়নি কোনও দিন। ওদের টাকার অনেক জোর। বড়লোকরা সব সময় ছাড় পেয়ে যায়।
কলকাতা জাগে না!
ঝপ করে জেসিকা লাল-হত্যা মামলার কথা মনে পড়ছিল। বিপক্ষে প্রবল পরাক্রান্ত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিনোদ শর্মার পুত্র মনু শর্মা এবং দাপুটে সাংসদ ডি পি যাদবের ছেলে বিকাশ যাদব। রাজনীতি এবং সমাজের উঁচুতলায় ঘোরাফেরা এবং পল্লবিত ‘কানেকশন’-এর জোরে বলীয়ান। এরাই তো রাতের রেস্তোরাঁয় সামান্য বচসার পর পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল বার করে এক মেয়েকে গুলি করবে। তার পর আত্মসমর্পণ করবে এবং সামান্য পুলিশ-পুলিশ খেলার পর ফিরে যাবে পরিচিত ক্ষমতার বৃত্তে। আদালতে মামলা চলার সময় নামী মডেল এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা দুম করে ‘বিরূপ’ হয়ে পড়বে। সাত-সাতটা বছর মামলা চলার পর নিম্ন আদালত বেকসুর খালাস করবে সবান্ধব মনুবাবুকে! আর দিল্লির নির্বান্ধব, স্বার্থপর সমাজ খানিকটা ‘আমি তো বাবা ভাল আছি’ মার্কা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আর খানিকটা হতাশার ঢোক গিলে বলবে, এ তো হওয়ারই ছিল। ঠিকই আছে।
ঠিকই তো! পেশাগত দায়িত্বে বেশ ক’টা বছর দিল্লিতে থাকাকালীন তো অন্য কিছু মনে হয়নি। ‘কালচার’ বলতে ‘এগ্রিকালচার’, সারা দেশ থেকে রুজির ধান্দায় জড়ো-হওয়া সবসময় দ্রুত ধাবমান এবং হৃদয়হীন মানুষ। তাদের অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর রুচি বা সময় কোথায়!
কী আশ্চর্য ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দিল্লি শহরটা! শহরের মানুষ। শহরের সংবাদমাধ্যম। শহরের নাগরিক সমাজ। শহরের মানবাধিকার সংগঠন। কলকাতাকে একটু মনে করিয়ে দিই?
২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। আদালতে বেকসুর খালাস হন সপারিষদ মনু। জনতার প্রবল চাপে ১৩ মার্চ দিল্লি হাইকোর্টে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে বাধ্য হয় পুলিশ। দৈনিক ভিত্তিতে শুনানি শুরু করে আদালত। সেই বছরেরই ডিসেম্বরে মনু, বিকাশ এবং তাদের সঙ্গী অমরদীপ সিংহকে গিলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মনু শর্মার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বাকি দু’জনের চার বছরের জেল।
সেই রায়ের বিরুদ্ধে আবার ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল মনু। দীর্ঘ তিন বছর শুনানি চলার পর যাবজ্জীবনই বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। বাবা-মা তত দিনে আর বেঁচে নেই। দিল্লির ‘স্বার্থপর এবং হৃদয়হীন’ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে লড়ে-যাওয়া জেসিকার বোন সাব্রিনা লাল বলেছিলেন, “একজোট হলে উঁচুতলার লোকেদের শাস্তিও অসম্ভব নয়। সেটা প্রমাণ হয়ে গেল!”
কলকাতার মনে পড়ে না!
সংবেদনশীল কলকাতা। দার্শনিক কলকাতা। শোকাহত কলকাতা। স্মৃতি-কাতর কলকাতা। মোমবাতি-জ্বালাতে, পোস্টার লিখতে, ফুলের তোড়ায় শ্রদ্ধা জানাতে ব্যস্ত কলকাতা। মৌনীমিছিলে রত কলকাতা। ‘ওদের কিছু হবে না’ ভেবে হতাশ কলকাতা।
৪৩ জনের মৃত্যুর জন্য গ্রেফতার হয়েও জামিন পেয়ে যে কলকাতার সমাজে নিশ্চিন্তে ঘোরেন পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের মালিক। আমরা কেউ ফিরেও তাকাই না। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। স্টিফেন কোর্টের মুখগুলো মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় উপরের বারান্দা থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় লাফ দিয়ে-পড়া চেহারার সিল্যুয়েট। ব্যস্ত জীবন জায়গা নেয় সাময়িক আক্রোশের। ক্রমশই এই বিশ্বাস গভীর, গভীরতর ভাবে প্রোথিত হয়ে যায়, কিচ্ছু হয় না। কিচ্ছু হবে না। কোথাও কেউ বলছে না, ছাড়ব না! চাপ দেব। চাপ দিয়েই চলব। ওরা যেন ছাড়া না-পায়।
ভাল লাগছে না।
মনে হচ্ছে, একটি মেয়ের মৃত্যুতে প্রশাসন-আইনের উপর চাপ তৈরি করল স্বার্থপর এবং অসাংস্কৃতিক বলে গোটা দেশে পরিচিত দিল্লি। পাশে দাঁড়াল দিদির মৃত্যুর জন্য আইনি লড়াই লড়তে-থাকা এক যুবতীর। জিতল।
কলকাতায় মারা গেলেন ৯০-এরও বেশি মানুষ। কী অসহায় সেই মৃত্যু! খবর পেয়ে পাগলের মতো দৌড়ে এসে প্রিয়জনেরা দেখলেন, দু’ঘন্টা ধরে বন্ধ রইল হাসপাতালের গেট। হাসপাতালের নিরাপত্তার স্বার্থে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হল না নিরুপায় মৃত্যুর দিকে হাঁটতে-থাকা অসুস্থ মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে পাশের বস্তি থেকে ছুটে-আসা যুবকদের। উদ্ভ্রান্ত পরিজনদের সামান্য তথ্যটুকু দেওয়ার জন্য হাসপাতালের তরফে জনপ্রাণীও প্রায় রইল না। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে নিহতদের পরিবারের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল বেলা গড়াতে না-গড়াতেই। অর্থ দিয়ে কি কিনে নেওয়া যায় স্বজনহারার ক্ষতি! অর্থ দিয়ে ঢাকা যায় সীমাহীন অপদার্থতা!
কলকাতা তবু শুধু মৌনী মিছিলে। কলকাতা তবু শুধু পোস্টার, ফুলের তোড়ায়। কলকাতা তবু দার্শনিক। কলকাতা তবু বলে, জীবন চলতেই থাকে।
কলকাতা বলতে পারে না, এত দিন চলেছে, আর এ ভাবে চলবে না জীবন!
কলকাতার রাগ হয় না। কলকাতা শুধু শোকেই কাতর!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.