প্রবন্ধ ১...
জলেও রক্তের গন্ধ
ত অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মর গদ্দাফির মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু এবং লিবিয়ার পট পরিবর্তন নিয়ে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটা: এই ক্ষমতার যুদ্ধের পিছনে উদ্দেশ্যটা কী? কোনও এক অত্যাচারীর শাসনে দেশের মানুষ বড় কষ্টে আছে বলে তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্যে ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ এ ধরনের কথা দুনিয়ার বড় বড় শক্তিরা বলে থাকেন বটে, কিন্তু কেউ তেমন বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। আমরা প্রথমেই খোঁজ নিতে শুরু করি, দেশটার কী ছিল, যার জন্যে এই যুদ্ধ? ইদানীং বেশির ভাগ যুদ্ধের পিছনেই মূল উদ্দেশ্য হিসেবে উঠে এসেছে একটি সম্পদ: তেল। লিবিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল। লিবিয়ার মাটির নীচে বিশাল তেলের ভাণ্ডার, যার জোর গদ্দাফিকেও রাজনৈতিক শক্তি জুগিয়ে চলেছিল এত দিন। আমেরিকা আর ইউরোপকে তেল দিতেন (আক্ষরিক অর্থে) বলেই বহু দিন পশ্চিমের সমর্থন পেয়েছিলেন গদ্দাফি। এ বার কিন্তু একটা নতুন কথা শোনা যাচ্ছে। লিবিয়া দখলের পিছনে আসল কারণ নাকি তেল নয়, জল। জলযুদ্ধ মানে আমরা এত দিন জানতাম জলপথে যুদ্ধ। এ বার কিন্তু সন্ধি সমাস উল্টে গিয়ে নতুন মানে হল, জলের জন্যে যুদ্ধ!
১৯৫৩ সাল নাগাদ, লিবিয়ার মাটিতে তেলের জন্যে খোঁড়াখুড়ি করতে গিয়ে আবিষ্কার হয় যে লিবিয়া, চাদ, ইজিপ্ট আর সুদান-- এই চারটি দেশের মাটির নীচ জুড়ে আছে এক বিশাল শিলীভূত জলভাণ্ডার। এর নাম দেওয়া হয় ‘নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার’। বলা হয়, এই জলভাণ্ডারের জন্ম হয়েছিল গত তুষার যুগে। এখন এই জলভাণ্ডারে আর নতুন করে জল ঢুকছে না, কিন্তু যা জল জমে আছে, তা একটু নিয়ন্ত্রিত হারে ব্যবহার করলে আগামী ১০০০ বছর ধরে এই চারটি দেশ সহ আফ্রিকার বৃহত্তর একটি এলাকাকে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা করে তোলা ও রাখা যাবে।
জল-যুদ্ধ! লিবিয়া, ২০১১। ছবি: রয়টার্স
১৯৮৩ সালে গদ্দাফি এক বিশাল জলপ্রকল্প শুরু করেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্য গ্রেট ম্যান-মেড রিভার’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কুফ্রা, সিরতে, মরজুক, হামাদা আর এই নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার থেকে জল নিয়ে লিবিয়ার তটবর্তী শহরগুলোতে সরবরাহ করা হতে থাকে। প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, ৫০০ মিটার নীচের হারানো জলভাণ্ডার থেকে জল তুলে এনে ৫০০০ কিলোমিটারের পাইপলাইন ধরে বয়ে চলা এই মানবনির্মিত নদী যেন রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাকেই মনে করিয়ে দিল, যে নদী মরুপথে হারাল ধারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা। গদ্দাফির সমর্থকরা দাবি করেন যে, আর্থিক ঋণদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক নির্ভরশীলতা তৈরির পশ্চিমি কায়দা-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের তেল বেচার টাকায় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করে মুয়াম্মর উন্নত দেশগুলোর চক্ষুশূল হয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছিলেন যে, এই জলের জোরে লিবিয়া, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান জোয়াকিন ভ্যালির মতো কৃষি-বিপণন শুরু করতে পারবে। ক্যালিফোর্নিয়া তো আগে মরুভূমির মতোই ছিল। সেচের মাধ্যমেই সে অঞ্চল দুনিয়ার খাদ্য আর তুলো উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কেউ বলছিলেন, ইউরোপের সুপারমার্কেটগুলোয় খাবার জোগান দেওয়ায় এগিয়ে আছে ইজরায়েল আর মিশর। সেচ ব্যবস্থা ঠিক হলে কিন্তু লিবিয়াও ওদের সঙ্গে পাল্লা দেবে।
পশ্চিম ব্যাপারটাকে খুব ভাল চোখে দেখেনি। সাদ্দামের সময় যেমন পশ্চিমি মিডিয়া ইরাকের সেই শাসকের হাতে রাসায়নিক মারণাস্ত্র থাকার ভূরি ভূরি ‘প্রমাণ’ জোগাড় করে ফেলেছিল, লিবিয়ার ক্ষেত্রেও গল্পটা খুব আলাদা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসে বেরুল: “লিবিয়ার রহস্যজনক পাইপলাইন সেনা পরিবহনের জন্যে নির্মিত?”। সাংবাদিক রেমন্ড বনার নাকি ওই প্রকল্পে কর্মরত ইঞ্জিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ পাইপলাইন নির্মাণের পেছনে যে সব কারণের কথা বলছেন, সেগুলো অযৌক্তিক ও অসম্পূর্ণ। এমনও হতে পারে যে, মিশর থেকে টিউনিসিয়া জুড়ে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে সেনা, জৈব অস্ত্র আর সামরিক সরবরাহ চলাচল করবে! একটা দেশে জল সরবরাহের জন্যে পাইপ বসানো কেন অযৌক্তিক আর অসংলগ্ন হবে, সেটা বোঝা কঠিন। যাক গে। গদ্দাফি ও বিরোধী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের সময় ওই পাইপ লাইনে ন্যাটো বাহিনির বোমাবর্ষণ নিয়েও ঝড় ওঠে। বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে গদ্দাফির সমর্থকরাও ওই পাইপলাইনে আক্রমণ চালায় বলেও অভিযোগ।
লিবিয়ার এই জলের কাহিনি আমাদের কয়েকটা জিনিস নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক সময়ই তার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করে। ইরাকের মানুষ সে কথা জানেন, আফ্রিকার হিরে ফলানো দেশের লোকেদেরও তা অজানা নয়। নদীর জলের দখল আর ভাগ নিয়ে লড়াইও নতুন নয়। মাটির নীচের জল সেই তালিকায় নতুন সংযোজন। দুনিয়াব্যাপী তেলের সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে তার বিকল্প নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগ যে ভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে কয়েক দশকের মধ্যে তেলের রমরমা চলে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু জলের বিকল্প এখনও তেমন ভাবে বেরোয়নি। সমুদ্রের জলের লবণ বিয়োগ নাকি এখনও খরচ সাপেক্ষ, তাই জলের নীচে পানীয় জলের ভাণ্ডার দুনিয়াদারির ব্যবসার কাছে খুবই লোভনীয়। আমাদের প্রায় অলক্ষ্যে বিশ্ববাজার দখলের প্রয়োজনীয় রসদের পরবর্তী ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে আফ্রিকার মাটি। এই শতকে যদি আবার কোনও বিশ্বযুদ্ধ হয়, সেটা আফ্রিকার দখল নিয়ে হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। নিজের রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এই দখলদারির খেলায় আপাতত সবচেয়ে বেশি এগিয়ে চিন। আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নানা ধরনের সহায়তার মধ্যে দিয়ে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ভারতও চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা নিজের দেশেই জোট রাজনীতি, টু জি আর এফ ডি আই জাতীয় ‘খুচরো’ ঝামেলা সামলাতে এত নাজেহাল, যে চিনের মতো পাইকারি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। তবে ভারতীয় ব্যবসাদারেরা একেবারে পিছিয়ে নেই। কিছু কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা করা সংস্থা আফ্রিকার কিছু দেশে প্রচুর জমি কিনছেন। নানান ভাবে ভারতীয় লগ্নি ছড়িয়ে পড়ছে।
মনে রাখা দরকার, পরিবেশ সমস্যা এখন বিশ্ব বাজারের গলায় কাঁটা। উন্নত দেশগুলোতে নতুন কারখানা, খনি বানানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বেপরোয়া উৎপাদনের জন্যে তো বেপরোয়া ভাবে কাঁচামাল তুলতে হবেই। বিপুল কৃষি ব্যবসার জন্যে জি এম শস্যের চাষ করতে হবেই। ধনতন্ত্র আগামী বছরের ব্যালান্স শিটের থেকে খুব দূরের কিছু দেখতে পায় না। তাই গরিব দেশ চাই, চাই তছনছ করে দেওয়া মানব জমিন।
অনেক আগেই আমাদের কোনও এক বাদশা বুঝেছিলেন যে, কেবল রাজধানী বানালেই হয় না। রাজত্ব করতে গেলে জল চাই। জলের অভাবে রাজধানী ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আধুনিক কৃষি ও শিল্পে যে পরিমাণ জল লাগে, তার জোগান না থাকলে, কম মজুরিতে খাটা ঠিকে শ্রমিকদেরও দিনের শেষে এক গেলাস জল দিতে না পারলে তো তারা মরেই যাবে। তাই জল চাই। মঙ্গল গ্রহে জল পাওয়া গেলেও আপাতত তার ব্যবস্থা দূর অস্ত। তার চেয়ে কয়েকটা দেশ দখল অনেকটা শস্তা পড়ে।
জলে কী রকম একটা রক্তের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না? আগামী দিনের সম্পদ নাকি সৌরশক্তি বা সোলার এনার্জি। যে দেশে রোদ বেশি, তারা আর কত দিন নিরাপদ থাকবে? বোমা পড়ার আগে বাচ্চাকে তেল মেখে রোদে দিয়ে দিন।
পাহারায় থাকবেন কিন্তু।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.