|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
‘উদ্বাস্তু’ আর ‘অনুপ্রবেশকারী’ গুলিয়ে ফেললে মুশকিল |
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ ২০০৫ সালের ১০ মার্চ লোকসভায় বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের খাঁটি উদ্বাস্তু (বোনাফাইড রিফিউজি) রূপে গণ্য করে তাঁদের সপক্ষে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘের (ইউ এন ও) বিধি অনুযায়ী উদ্বাস্তুদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে’। ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আডবাণীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ হওয়ার পরেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতন ভোগ করছেন। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এ দেশে আসা হতভাগ্য মানুষগুলিকে সুরক্ষা দেওয়া এবং ভাগ্যহীন লোকদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়াকে অধিকতর সহজ (মোর লিবারেল) করে তোলা’। রাজ্যসভায় ডেপুটি চেয়ারপার্সন নাজমা হেপতুল্লা তখন মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরাও দুর্ভোগে আছেন। তাঁদের বিষয়েও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। উপপ্রধানমন্ত্রী আডবাণী মনমোহন সিংহের মতকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বদাই বলি যে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বলি হয়ে কোনও ব্যক্তি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে এ দেশে এলে সে খাঁটি উদ্বাস্তু। অন্য কোনও কারণে এমনকী অর্থনৈতিক কারণে আসা বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের এক পর্যায়ভুক্ত করা যায় না’। ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আডবাণী সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল-২০০৩’ পেশ করেছিলেন অত্যাচারিত হয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের রক্ষার জন্য।
কিন্তু দেশের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আডবাণী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের প্রতিশ্রুতি অসত্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি সি এল গোয়েলের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মাচের্র পর বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তিতে বাধা-নিষেধ আরোপ করে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে চিঠি (নং ২৬০১১/১৬/৭১-১০ নতুন দিল্লি ২৯/১১/১৯৭১) দিয়ে বলা হয়, ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের ৫/১ (এ) ধারা এবং ১৯৫৬ সালের নাগরিকত্ব নিয়ম অনুসারে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত হবে না। মজার ব্যাপার, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দি-পঞ্জাবিভাষী হিন্দুদের ভারতের গুজরাত, রাজস্থানে বসবাসের জন্য ১৯৫৬ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন ঘটানো হয়। যা ‘নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০০৪’ হিসেবে পরিচিত।
|
 |
ইতিহাস। উদ্বাস্তুর ঢল, ১৯৪৭। |
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বলি হয়ে, অত্যাচারিত হয়ে যে-সব হিন্দু পরিবার এ দেশে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাদের এ দেশে গ্রহণ করা হবে বলে ১৯৫০ সালের ইমিগ্রেন্ট এক্সপালশন ফ্রম অসম অ্যাক্ট-এর ২ নং ধারায় ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি হয়ে যাঁরা অসমে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের বিতাড়ন করা যাবে না। আইনে সে কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ইন্দিরা-মুজিব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর করা হয়নি। রাষ্ট্রসঙ্ঘেও উদ্বাস্তু সম্পর্কীয় সংজ্ঞাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৪২৮ (৫) নম্বর প্রস্তাব মর্মে উদ্বাস্তুদের সংজ্ঞা নির্ণয় করে বলা হয়, ‘তাঁরাই উদ্বাস্তু যাঁরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে অত্যাচারিত হতে পারে, এ-রকম আশঙ্কা থেকে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে এসেছেন। সেই ব্যক্তিই শরণার্থী বা উদ্বাস্তু। কিন্তু, অসমের বাঙালিদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু সম্পর্কীয় সংজ্ঞা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত অঙ্গীকারসবই ব্রহ্মপুত্রের জলে ভেসে গেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের শিকার হয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে অসমে আসা বাঙালিরা প্রশাসনিক হেনস্থার শিকার হচ্ছে। প্রতিপদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। যে সব হিন্দু বাঙালির জন্ম-কর্ম সব এ দেশে, আগাগোড়া এ দেশেরই নাগরিক, তবুও তাঁদের পদবি দেখে দেখে ভোটার তালিকার নামের পাশে ‘ডি’ চিহ্ন বসিয়ে তাঁদেরকে সন্দেহজনক নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে। এমন বিপজ্জনক অপকর্মের নজির ভূ-ভারতে নেই। ‘ডি’ অর্থাৎ ডাউটফুল অথবা ডিসপিউটেড ভোটার। খুন রাহাজানি না-করেও তাঁদের জেল খাটতে হচ্ছে। ডিটেনশন ক্যাম্পে বিনা বিচারে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হচ্ছে। রাজ্যে ১ লক্ষ ৫২ হাজার ২৫৫ জন ‘ডি’ ভোটার আছেন। তাঁদের ভাগ্যে কখন যে কী ঘটবে কেউ জানে না। ভারতীয় নাগরিক, তাঁরা আবার সন্দেহজনকও। খুব মজার কথা, তাই না? বিনা দোষে জেল খাটছেন ১৪৮ জন। কোকরাঝাড়, গোয়ালপাড়া এবং কাছাড়ের শিলচরের জেলখানায় তাঁদের আটক রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রায় দুই লক্ষাধিক ‘ডি’ ভোটারকে তাঁদের ভোটাধিকার বাতিল করার বিষয়ে তৎপর হওয়ার সময়েই রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হল, চিহ্নিতদের মধ্যে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ২১৮ জনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই লোকগুলি গেল কোথায়? গুয়াহাটি হাইকোর্টের নির্দেশ-মর্মে সরকারি পরিভাষায় বলা হচ্ছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ এর কোনও অস্তিত্ব নেই রাজ্যে। খুন, জখম না-করেও জেলখানায় আটকে রাখা ভারতীয় নাগরিকদের পেট পুরে দু’বেলা ডালভাতও খেতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার বলছে, রাজ্যে ১৫ হাজার ৪৯০ জনকে বিদেশি হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ১২ হাজার ৩৮৬ জন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাজ্যে বিদেশি শনাক্তকরণ ট্রাইবুনাল আছে ৩৬টি। নিধিরাম সর্দারের মতো এই ট্রাইবুনালগুলি নামে মাত্র আছে। সন্দেহজনক নাগরিকদের মামলাগুলি বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। ‘ডি’ ভোটারদের চরম হেনস্থা করা হচ্ছে। বিচারের নামে প্রহসন চলছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনও প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। অথচ সন্দেহজনক নাগরিকদের বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। এমনও ঘটেছে, স্বামী ভারতীয়, স্ত্রী বাংলাদেশি। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে হয় ডিটেনশন ক্যাম্প, নয় নো ম্যানস ল্যান্ডে পুশ ব্যাক করা হচ্ছে। কী আজব কথা! অথচ এ নিয়ে কোনও প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই।
অমল গুপ্ত। অসম, গুয়াহাটি-৬
|
অসীম চট্টোপাধ্যায়ের ‘উদ্বাস্তুরা হঠাৎই অনুপ্রবেশকারী হয়ে গেলেন’ (১৭-১১) লেখাটি আমাদের চিন্তায় একটা কশাঘাত বলে মনে হয়েছে। ‘দেশভাগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায়’ হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রনীতি উদ্বাস্তুদের আর দেখতে চাইছে না। রাষ্ট্র বিপর্যয়ের কথা বাদ দিলেও আমরা জানি, স্থান থেকে স্থানান্তরে বাঁচার জন্য দল বেঁধে মানুষকে চলে যেতে হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক সত্য, রাষ্ট্র-বিপর্যয় পৃথিবীর নানা দেশেই বারংবার নতুন নতুন উদ্বাস্তু সৃষ্টি করে চলেছে। এই উদ্বাস্তুরা বেশির ভাগই ‘দরিদ্র, অশিক্ষিত, দলিত’। অর্থনৈতিক দুঃসময়েও স্বভূমি স্বদেশ ছেড়ে কত অসহায় নরনারী পালিয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। তাদের মেনে নিতে হয়েছে লাঞ্ছনা, নির্যাতন।
আমেরিকায় স্বভূমিচ্যুত কত মানুষই চলে গেছে শুধু মাত্র বাঁচার জন্য। মেক্সিকো থেকে প্রচুর মানুষই আমেরিকায় নানা হোটেলে, দোকানে কাজ করছেন। এমনকী মস্কো থেকে অনেক কিশোরী, যুবতী বড় শহর ছাড়াও অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট শহরে (যেমন, সিনাসিনাটি) ঘর পরিষ্কার করার কাজ করছে। ভারতের অনেক অঞ্চল থেকেও প্রচুর সাধারণ শ্রমজীবী নারী ও পুরুষকে শপিং মল প্রভৃতিতে কাজ করতে দেখেছি। তাদের চোখেমুখে অব্যক্ত বেদনা। তাদের আমরা কী বলব? আমরা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হয়ে বলব, আমাদের দুঃখের ইতিহাস কত বার দেখবে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা? আমাদের দেশের রাজনৈতিক ঘটনাধারায় যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং অক্ষমতায় তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ঘোষণা করে আমরা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছি না?
মুরারি ঘোষ। শিবপুর, হাওড়া-২
|
গান নিয়ে |
আনন্দবাজারে প্রকাশিত ড. কানন গোস্বামীর চিঠিতে (২১-১১) ড. ভূপেন হাজারিকা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া যে গানটি উল্লেখ করেছেন সেটি হল, ‘আঁকাবাঁকা এ পথের দুধারে নয় ওগো ফুলে ফুলে ছাওয়া’। এই গানটি পরবর্তী কালে ভূপেন হাজারিকার গাওয়া গান ‘দোলা’ নয়। এই গানের সুরটি ‘দোলা’ গানে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই গানটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। রেকর্ড নং- জি ই ২৪৮৬২। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই রেকর্ডের অপর দিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ভূপেন হাজারিকার দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ‘গুমগুম মেঘ ওই গরজায়’ গানটি একটি অসমীয়া গানের বাংলা ভাষান্তর। মূল অসমীয়া গানটি হল, ‘গুমগুম গুমগুম মেঘ ওই গরজিলা’। যেটি এই শিল্পীদ্বয় দ্বৈত কণ্ঠে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। ‘এরা বটর সুর’ নামে একটি অসমীয়া ছবিতে গেয়েছিলেন। অসমীয়া গানটির রেকর্ড নং-৩০৮০৪ (১৯৫৬)
জয়দীপ চক্রবর্তী। সাউথ সিথি, কলকাতা-৫০ |
|
|
 |
|
|