অগ্নিবিধি না মানার জন্য আমরি ঢাকুরিয়া-র লাইসেন্স বাতিল করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু এই নিয়ম যদি মানতে হয়, তা হলে কলকাতার প্রধান পাঁচটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাইসেন্সও অবিলম্বে বাতিল করা উচিত কি না, এ বার তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। প্রশ্ন উঠল, কেনই বা দমকল ওই হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে মামলা করবে না।
কলকাতার প্রধান পাঁচটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফায়ার লাইসেন্স-ই নেই। চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, যে সব বিধি না মানার জন্য দমকল আমরি-র বিরুদ্ধে মামলা করেছে সেই মামলা করা উচিত এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, আরজিকর মেডিক্যাল এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধেও। কারণ, ওই হাসপাতালগুলির কেউই অগ্নিবিধি মানছে না। ফায়ার লাইসেন্স না নেওয়ায় সরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে দমকল কি কোনও ব্যবস্থা নেবে? দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “সোমবার থেকে আমরা সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে পরিদর্শন শুরু করব। নিয়ম না মানলে কেউ ছাড় পাবে না।”
সরকারি হাসপাতালগুলির যে ফায়ার লাইসেন্স নেই, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা কিন্তু অবহিত। তাঁদের বক্তব্য, বিষয়টি এত দিন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা শ্যামাপদ বসাক বলেন, “তেমন জোরালো কোনও ব্যবস্থা কোনও দিনই ছিল না। তবে এ বার ভাবার সময় এসেছে। আমরি-কাণ্ডের পরে আমরা সব হাসপাতাল-কর্তাদের ডেকে সতর্ক করে দিয়েছি।” স্বাস্থ্য দফতরের কেউ কেউ বলছেন, “দুই-একটি মেডিক্যাল কলেজের ফায়ার লাইসেন্স ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু তা নবীকরণ হয়নি।” স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, স্টিফেন কোর্টে আগুন লাগার পরেও শিক্ষা নেয়নি স্বাস্থ্য দফতর।
|
আবর্জনার স্তূপ সিঁড়িতে। বন্ধ পথ। এসএসকেএম হাসপাতালের রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ে রাজীব বসুর ছবি। |
দমকল কর্তাদেরও এত দিন জানা ছিল না যে, বেসরকারি হাসপাতাল ফায়ার লাইসেন্স নিলেও সরকারি হাসপাতালগুলি তার ধার ধারে না। যদিও অতীতে এসএসকেএম এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে বিষয়টি উঠে এসেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। এই হাসপাতালগুলিতেই কয়েকশো মানুষ ভর্তি থাকেন প্রতিদিন। রোগীদের কয়েকশো আত্মীয়স্বজন রাত কাটান হাসপাতাল চত্বরে। আউটডোরে রোজ আসেন অসংখ্য মানুষ। যে কোনও বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় যা চার গুণ। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে মাঝেমধ্যে আগুন লাগলেও
কেন এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত রাজ্য প্রশাসন? প্রশ্ন উঠেছে।
এসএসকেএমের কথাই ধরা যাক। ২০০৭ সালে এই হাসপাতালের ক্যান্টিনে বড় ধরনের আগুন লেগেছিল। সেই আগুন এক কর্মীর প্রাণ নিলেও কর্তৃপক্ষ তা থেকে কোনও শিক্ষা নেননি। এত বড় একটা হাসপাতাল চালাতে গেলে আগুন নেভানোর যা যা ব্যবস্থা থাকা দরকার, তার কিছুই এখানে নেই। নাম কা ওয়াস্তে বেশির ভাগ বিল্ডিংয়ে দু’টি করে সিঁড়ি রয়েছে। এক দিকের সিঁড়ি কার্যত ব্যবহারই হয় না। কোলপসিবল গেটে তালা ঝোলে। ফলে আগুন লাগলে বা অন্য কোনও বিপর্যয়ে রোগী বা হাসপাতালের কর্মীরা যে বিকল্প পথ দিয়ে বাইরে বেরোবেন, তার কোনও উপায় নেই। প্রায় প্রত্যেক তলাতেই সিঁড়ির মুখ আটকে বিভিন্ন বিভাগের বাড়তি জিনিসপত্র, আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে দাহ্য পদার্থও।
সপ্তাহ কয়েক আগেই এসএসকেএমের রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার একটি ঘরে আগুন লাগে। শনিবার বিকেলে লাগা সেই আগুন ধিকিধিকি করে পরদিন সকাল পর্যন্ত জ্বলেছিল। সকালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা তা দেখতে পেয়ে নেভানোর ব্যবস্থা করেন। তাতে একটি ঘর এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, অবিলম্বে তা মেরামতির ব্যবস্থা করতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
ওই বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “এক দিকের রাস্তা তালা বন্ধ থাকায় কী কী বিপদ হতে পারে, তা জানিয়ে একাধিক বার অধিকর্তাকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু ফল হয়নি।” ওই বিল্ডিংয়েই রয়েছে বার্ন ইউনিট, রয়েছে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ। রয়েছে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, মেডিসিন, এন্ডোক্রিনোলজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের চিকিৎসকদের ঘর। কার্ডিওলজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেও বিকল্প পথের কথা একাধিক বার বলা হয়েছে। কিন্তু এখনও তার ব্যবস্থা হয়নি। এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “বিকল্প ব্যবস্থা বাড়াতে হলে নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থাও বাড়াতে হবে।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পর দমকল কর্তারা এক বার হাসপাতালে এসে কী কী করতে হবে বলে গিয়েছিলেন। জরুরি ভিত্তিতে উঁচু বাড়ি থেকে রোগী ও অন্য লোকেদের নামিয়ে আনার জন্য ‘ফোল্ডিং ল্যাডার’ কেনার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরে সেই প্রস্তাব পাঠানোর পর কোনও উত্তর আসেনি। হাসপাতালের রেজিস্ট্রার কুন্তল বিশ্বাস বলেন, “মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছিল বলে নতুন কয়েকটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেনা হয়। কিন্তু অডিট তার জন্য হাসপাতালকে ভর্ৎসনা করে জানতে চায়, যে জিনিস সব সময় ব্যবহার হয় না, তা কেনা হল কেন? এর পর আমরাও পিছিয়ে এসেছি।” রবিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল, নিষেধ সত্ত্বেও নার্সদের রেস্ট রুমে হিটারে চা-ডিমসেদ্ধ হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে ইলেকট্রিকের পুরনো তার। ইমার্জেন্সির পিছনের দিকের দরজা এবং ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের তিন তলায় পেডিয়াট্রিক সার্জারির এক দিকের দরজা তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ নিরাপত্তারক্ষীর অভাব। |
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, আগুন নেভানোর যন্ত্র বহু বছর আগে এক বার কেনা হয়েছিল। কিন্তু তা অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। চার দিকে পুরনো ইলেকট্রিকের তার ঝুলছে। মাঝেমধ্যেই ছোটখাটো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পূর্ত দফতরের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের কর্মীদের ডেকেই দায়িত্ব সারা হয়েছে। মাস চারেক আগে ন্যাশনালের চক্ষু বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে আগুন লেগেছিল।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র থেকে শর্ট সার্কিট হয়েই আগুন লাগে। ওই বিভাগের এক জুনিয়র ডাক্তার বলেন, “ওই সময়ে যদি অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে যেত কিংবা রাতের দিকে যদি ঘটনাটা ঘটত, তাহলে বড় রকমের বিপদ হতে পারত।
কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষা নেননি, এটাই দুর্ভাগ্যের।” ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধানও স্বীকার করেছেন, কোনও পরিকাঠামোই তাঁদের নেই। তাঁর কথায়, “কয়েকটা ওটি-তে আগুন নেভানোর ছোট যন্ত্র আছে। কিন্তু তা বোধহয় কেউই চালাতে জানেন না।”
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন শেষ কবে ফায়ার এক্সটিংগুইশার কেনা হয়েছে তা তাঁদের মনে নেই। কোনও আপৎকালীন নির্গমন পথ, ফায়ার অ্যালার্ম কিছুই নেই। হাসপাতালে ২টি বেসমেন্টে প্রচুর দাহ্য পদার্থ আছে, কিন্তু আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই। আরজিকর হাসপাতালের ছবিটাও প্রায় এক। কোনও দিন ফায়ার ড্রিল হয় না। ফায়ার এক্সটিংগুইশার কাজ করছে কিনা কেউ খতিয়ে দেখে না।
এখানেও বেসমেন্টে হাসপাতালের গুদাম। ৭০ শতাংশ দাহ্য জিনিস, কিন্তু আগুন সামলানোর ব্যবস্থা নেই। আমরির ঘটনার পরে কর্তৃপক্ষ এখন সেটি অন্য জায়গায় সরানোর কথা ভাবছেন। ডেপুটি সুপার সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, “একাধিক বার দমকলকে আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ দিতে, ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে এবং মক ড্রিলের জন্য আসতে বলে চিঠি লেখা হয়েছে। কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।”
|