ঘটনার তিন দিন পরেও গোটা শহরের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকল ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল চত্বর। রবিবারও ‘অভিশপ্ত’ সংযুক্ত-ভবন (অ্যানেক্স-বিল্ডিং) ঘিরে পুলিশি ব্যারিকেড বহাল ছিল। তবু রাত পর্যন্ত দফায় দফায় হাসপাতালের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে এত জনের মৃত্যুশোকের শরিক হতে চেয়েছেন শহরের বিশিষ্টজন থেকে আমজনতা। তার মধ্যেই এ দিন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটির বেসমেন্ট থেকে বিকেলে আচমকা ফের ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরোতে দেখে এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। অনেকেই ছুটে আসেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই অবশ্য ধোঁয়া বেরনো বন্ধ হয়ে যায়।
শুক্রবারের অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা এ দিন বেড়ে হয়েছে ৯৩। এ দিন দুপুরে মিন্টো পার্কের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নীলা দাশগুপ্ত (৮৫) নামে এক বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন। শুক্রবার সকালে হাসপাতাল থেকে উদ্ধারের পরেই তাঁকে ওই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এ দিন সেখানে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। নিউ টাউন থানার কনস্টেবল বাবুলাল ভট্টাচার্যেরও শেষরক্ষা হল না। জ্বর নিয়ে তিনি আমরি-তে ভর্তি হয়েছিলেন। উদ্ধারের পরে দু’দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েও শুক্রবার রাতে সল্টলেকের আমরি-তে তিনি মারা যান।
ধোঁয়ায়-ঢাকা হাসপাতাল থেকে রোগীদের উদ্ধারে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই পঞ্চাননতলা বস্তির বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে প্রশাসনের। এ দিন কলকাতা পুরসভার তরফে পঞ্চাননতলায় স্থানীয় যুবকদের জন্য একটি স্বাস্থ্য-শিবির চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার আমরি-র ভিতরে ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়া দু’জন যুবক শঙ্কর মাইতি ও তড়িৎ পুরকায়েত এখনও অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকার ছেলেরা অনেকেই না কি শুক্রবার দুপুর থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। মেয়র পরিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “ওই তল্লাটে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গিয়ে শীঘ্রই পঞ্চাননতলার ছেলেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা হবে। স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিক করছি।” |
আমরি সংলগ্ন পার্কে ঢোকার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের উল্লাস। রবিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
হাসপাতালের পাশে একটি পার্ককে কেন্দ্র করে এ দিন স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। ২০০৮ সালে আমরি হাসপাতাল ও পুরসভার যৌথ উদ্যোগে পার্কটি তৈরি হয়। পঞ্চাননতলার বাসিন্দাদের দাবি, এলাকার খেলার মাঠ দখল করে পার্কটি তৈরি হয়েছে। এ দিন পার্কের তালা ভেঙে ফেলা হয় বলে অভিযোগ। কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই পার্কের আইনগত বিষয়গুলি দেখেই সিদ্ধান্ত নেব।”
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল এ দিন ওই হাসপাতালের বেসমেন্ট থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ফিরে আসে। বেসমেন্টে এখনও জল জমে থাকায় তাঁরা তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেননি।
ঢাকুরিয়া উড়ালপুলের নীচের হাসপাতাল-চত্বরে রবিবার সারা দিন ধরে জড়ো হওয়া জনতার আলোচনায় বার বারই এত জনের মৃত্যুর কথা যেমন উঠেছে, তেমনই এসেছে হাসপাতাল লাগোয়া পঞ্চাননতলার বস্তির নামটাও। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সুস্মিতা ভট্টাচার্য, সিটি কলেজের অদিতি মিত্র বা বিজয়গড় কলেজের কৌশিক নস্করদের চোখে ওই বস্তির অকুতোভয় যুবকেরাই যেন ‘নায়ক’। হাসপাতালের মূল ভবনের ফটকের পাশে পুলিশ প্রহরা। সেখান থেকে সংযুক্ত ভবনের পিছনে বস্তির টালির ঘরগুলো ভাল করে চোখে পড়ারও জো নেই। তবু কলেজের ছেলেমেয়ে থেকে প্রবীণদের আলোচনায় ঘুরে-ফিরে কাগজে পড়া বাসু, রণজিৎ, রাজুদের নাম। রোগীদের বাঁচাতে গিয়ে অসুস্থ যুবকদের নিয়ে সবারই উৎকণ্ঠা।
ঢাকুরিয়া উড়ালপুল থেকে নেমে আমরি-তে যাওয়ার রাস্তার মুখেই কারা যেন তৈরি করে ফেলেছে একটি শোক-বেদী। মৃতদের স্মরণে সেখানে তিরতির করে জ্বলছে কয়েকটি মোমবাতি। হাসপাতালের মূল ভবনের গেটের উল্টো দিকেও মোমের আলোতেই স্মরণ করা হয়েছে মৃতদের। মোমবাতির পাশে রাখা পোস্টার। তার একটিতে এই ‘লাশপাতাল’-এ ‘খুনি’দের শাস্তির দাবি করা হয়েছে। মিছিল করে কখনও ওই তল্লাটে এসেছেন দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজের শিক্ষার্থী ও তরুণ আইনজীবীরা, কখনও বা দেখা গিয়েছে টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র-জগতের কিছু পরিচিত মুখ। বিকেলের দিকে শিশু-কিশোরদের একটি দলও মোমবাতি হাতে থমথমে মুখে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়েছিল।
সহমর্মীতা প্রকাশ করতে সন্ধ্যায় আমরি-র সামনে গিয়েছেন চলচ্চিত্রকার অশোক বিশ্বনাথন, অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিৎ, প্রাক্তন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্রিকেটার রণদেব বসু, অভিনেতা সাহেব চট্টোপাধ্যায়রা। দোষীদের শাস্তি দিতে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করেছেন। কারও দাবি, শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নন, যাঁরা হাসপাতালে বিপদের সম্ভাবনা দেখেও ছাড়পত্র দিয়েছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধেও রাজ্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরি-কাণ্ডের ধাক্কায় গঠিত দমকলের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির আজ, সোমবার সকালেই বৈঠকে বসার কথা।
দুপুরে রবীন্দ্র সরোবরের পাশে সাফারি-পার্কে মৃতদের স্মৃতি-ফলক বসানোর অনুষ্ঠানে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাত আটটায় বিড়লা তারামণ্ডল থেকে গাঁধী-মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত শোক-মিছিলের পুরোভাগেও থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী।
|