জঙ্গলমহলের উন্নয়ন-কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবার মানোন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। সেই উদ্যোগের প্রথম ধাপে এলাকার গ্রামীণ হাসপাতাল, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির পরিকাঠামোর হাল-হকিকৎ জানতে চেয়েছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সম্প্রতি সেই রিপোর্ট তৈরি করেছে।
সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সবচেয়ে বড় সঙ্কট হিসাবে বিভিন্ন সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে ‘গোড়ায় গলদে’র বিষয়টি। গ্রামীণ হাসপাতাল, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ন্যূনতম পরিকাঠামোও না থাকাটাকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন সমীক্ষায়। পরিকাঠামো না থাকায় রোগীরাও প্রয়োজনীয় পরিবেষা পান না গ্রামীণ হাসপাতাল, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে। ওই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অনেকগুলিতে লেবার টেবিল, সাকার মেশিন, নেবুলাইজার, কিংবা সদ্যোজাত শিশুদের জন্য বেবি ওয়ার্মার, অটোক্লেভের মতো ন্যূনতম সরঞ্জামও নেই। রোগীদের স্থানান্তরে পর্যাপ্ত ট্রলিও পাওয়া যায় না। এই অবস্থা বদলাতেই জঙ্গলমহলের গ্রামীণ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কী কী সরঞ্জাম প্রয়োজন, তার তালিকা তৈরি করতে জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা মেনেই পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্র বলেন, “হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে যাতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।” দফতর সূত্রে খবর, এ সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানোও হয়েছে। ক’দিন আগেই কলকাতার বিধান শিশু হাসপাতালে এক দিনে অনেকগুলি শিশুমৃত্যুর ঘটনায় রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে। অভিযোগ, গ্রামীণ হাসপাতাল কিংবা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সদ্যোজাত শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে না বলেই প্রাথমিক চিকিৎসাতেও ত্রুটি থেকে যায়। ফলে, যখন গুরুতর অসুস্থ শিশুদের কলকাতায় রেফার করা হয়তখন আর প্রায় কিছু করারই থাকে না। গ্রামীণ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাকার মেশিন বা নেবুলাইজারের অন্তত পর্যাপ্ত জোগান যে প্রয়োজনসে কথাটাও সামনে আসে। সদ্যোজাত শিশুদের প্রথমে বেবি ওয়ার্মারেই রাখতে হয়। কিন্তু, অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেটুকুও না থাকার ফলে সদ্যোজাতের সঙ্কট বাড়ে। জঙ্গলমহলের একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকের কথায়, “পরিস্থিতি মোকাবিলায় অস্থায়ী ভাবে একটি টেবিলের উপর ২০০ ওয়াটের বাল্ব লাগিয়ে কাজ চালাতে হয়।” জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, প্রয়োজন অনেক কিছুরই। তার মধ্যে থেকেই জরুরি ভিত্তিতে কী কী প্রয়োজন, তার একটা তালিকায় তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা ধরেই সরঞ্জাম পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
ওই তালিকা অনুযায়ীই, বেলপাহাড়ি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্তত দু’টি সাকার মেশিন, দু’টি নেবুলাইজার, পাঁচটি বেবি ওয়ার্মার, আটটি ট্রলি প্রয়োজন। ট্রলিগুলির মধ্যে ছ’টি সাধারণ রোগীদের, দু’টি সদ্যোজাত শিশুদের জন্য। বিনপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চারটি লেবার টেবিল, দু’টি সাকার মেশিন প্রয়োজন। চিল্কিগড় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দু’টি লেবার টেবিল, শিশুদের জন্য দু’টি ট্রলি, দু’টি ফ্রিজ প্রয়োজন। তপসিয়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুদের জন্য দু’টি সাকার মেশিন, দু’টি ট্রলি, চারটি অটোক্লেভ, চারটি বেবি ওয়ার্মার, ব্লাড প্রেসার পরীক্ষার ছ’টি সরঞ্জাম প্রয়োজন। খড়িকামাথানি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুদের জন্য একটি সাকার মেশিন, একটি ট্রলি, ব্লাড প্রেসার পরীক্ষার পাঁচটি সরঞ্জাম, তিনটি অটোক্লেভ, তিনটি বেবি ওয়ার্মার প্রয়োজন।
জেলার হাসপাতালগুলিতেও মাঝেমধ্যেই শিশু-মৃত্যুর হার বাড়ে। তখন শোরগোল পড়ে। অভিযোগ ওঠে চিকিৎসায় গাফিলতির। যদিও সে সব ক্ষেত্রেও পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করেন কর্তৃপক্ষ। শিশু-মৃত্যু ঠেকাতে জেলার ৩টি হাসপাতালে ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ সংক্ষেপে ‘এসএনসিইউ’ এবং ৬টি হাসপাতালে ‘সিক নিওনেটাল স্টেবিলাইজেশন ইউনিট’ সংক্ষেপে ‘এসএনএসইউ’ গড়ে তোলার চিন্তাভাবনাও শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। এই সব বিশেষ ইউনিটে নবজাতকদের চিকিৎসায় অত্যাধুনিক সরঞ্জাম থাকবে। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকবেন চিকিৎসক। স্বাস্থ্যচিত্র বদলাতে নানা পরিকল্পনাই হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনা মতো কতটা কী কাজ শেষ পর্যন্ত হয়সেটাই এখন দেখার। |