অপেক্ষায় বউ-মেয়ে
প্রতিদিনের অভ্যাস মতোই রবিবার সকালেও প্রথম পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে খবরের কাগজ (আনন্দবাজার) ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিয়েছিলেন বুলা দে। রান্না সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসাটাই তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। হঠাৎই মেয়ে পায়েলের মোবাইলে ফোন আসে এক বান্ধবীর। উত্তেজিত গলায় পায়েলকে জানায়, “তোর বাবা কলকাতার পুড়ে যাওয়া আমরি হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তোরা কিছু জানতিস না। কাগজে তোর বাবার ছবি বেরিয়েছে। ফোন করে খোঁজ নে, উনি কেমন আছেন।” পায়েলের মাথায় যেন বাজ পড়ে। মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে আর্তনাদ করে ওঠে। মেয়ের চিৎকার শুনে রান্না ঘর থেকে বুলা দেবী এসে ফোনের কথা জেনে কাগজের পাঁচের পাতায় স্বামী বিকাশবাবুর ছবি দেখে তিনি বুকে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। মুহূর্তে জলপাইগুড়ির সুহৃদ লেনের বাড়িটাকে আতঙ্ক গ্রাস করে। মা-মেয়ের কান্নার শব্দ পেয়ে চলে আসেন বাড়ির মালিক অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কাগজ পড়ে জানান, বিকাশ বাবু সুস্থ আছেন। কোনও মতে বুলা দেবীকে টেনে তুলে বিছানায় বসিয়ে দেন। রান্না ঘরের গ্যাস বন্ধ করে দেন। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তাঁরা ফোন করেন বিকাশবাবুর মোবাইলে। বিকাশবাবুর স্বর শুনতে পেয়ে আশ্বস্ত হন তাঁরা। নদীয়ার দেবগ্রামে কর্মরত বিদ্যুৎ দফতরের বাস্তুকার বিকাশবাবু গত বুধবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার আমরি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সে খবর জানতেন না জলপাইগুড়িতে থাকা তাঁর স্ত্রী বুলা দেবী এবং মেয়ে পায়েল। আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৮৯ জন রোগীর মৃত্যুর কথা শুনে তাই আর পাঁচজনের মতোই বিহ্বল হয়েছিলেন তাঁরা। এর বেশি ভাবতেই পারেননি জলপাইগুড়িতে থাকা মা-মেয়ে। আমরির হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত বিকাশবাবুর ভর্তি থাকা, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো, তার পরে জানালার কাঁচ ভেঙে নিচে নেমে আসার ঘটনা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বুলা দেবী। বেড়ে গিয়েছে রক্তচাপ। মেয়ে পায়েলরও গলার স্বর নেমে গিয়েছে খাদে।
ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ পাল।
শিলিগুড়ির বেসরকারি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী পায়েল। গত ৩ ডিসেম্বর তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ভাঙা গলায় ভাঙা গলায় পায়েল বললেন, “আমার পরীক্ষার জন্যই বাবা আমাদের খবর দিতে না করেছিলেন। আজ সকালে সব জানতে পেরে ঠাকুমাকে ফোন করেছিলাম। ঠাকুমা জানাল বাবা নাকি সকলকে ‘দিব্যি’ করিয়ে আমাদের কিছু জানাতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের জানিয়ে দিলে বাবা হাসপাতালেই ভর্তি হবেন না।” গলা দিয়ে পাকিয়ে উঠছে কান্না। খানিকটা সামলে নিয়ে পায়েল বললেন, “আজ সকালে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। বাবা জানত যে আমরা অসুস্থতার খবর পেলেই কলকাতায় ছুটে যাব। যাতে আমার পরীক্ষা দিতে কোনও সমস্যা না হয় সেই জন্যই আমাদের কিছু জানাতে ঠাকুমা, কাকুদের পই পই করে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আজও ফোনে পরীক্ষা না দিয়ে আসতে বারণ করেছেন। বাবা বলেছেন, শুক্রবার ছুটি দেবে। তারপর জলপাইগুড়িতে আসবেন। আমার পরীক্ষাও বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে। যদি বাবার ছুটি না হয় তাহলে আমরাই চলে যাব।” রবিবার দুপুরে সুহৃদ লেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল মা-মেয়ে দুজনেই চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দু’একজন পড়শি বাড়িতে এসেছেন। বিকাশবাবুর শাশুড়ি অসীমা দেবীও জলপাইগুড়ির বাড়িতে থাকেন। তিনি মানসিক রোগগ্রস্ত। সকাল খবর শোনার পরে কিছুটা ধাতস্ত হয়েছেন বুলা দেবী। তবে কথা বলতে গেলেই হাঁফিয়ে উঠছেন। কথা বলতে গেলে বারবার ডান হাতে বুক চেপে ধরছেন। তিনি বললেন, “মেয়ের পরীক্ষা চলছে। আর আমার অসুস্থ মা-কে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। সব দিক ভেবেই আমাদের কিছু না জানাতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন উনি। আজ খবরটা শুনে গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। সমানে বুকে ব্যাথা শুরু হয়েছে। যাই হোক, শুক্রবার যদি ওঁর ছুটি না-হয় মাকে রেখে আমরা কলকাতায় যাচ্ছি।” বীরভূমের দুবরাজপুরের বাসিন্দা বিদ্যুৎ দফতরের বাস্তুকার বিকাশবাবু পরিবার নিয়ে প্রায় ১৮ বছর ধরে উত্তরবঙ্গে রয়েছেন। ৪৮ বছরের বিকাশবাবু নিয়মিত খেলাধুলা করেন। মেয়ে পায়েল বলে, “এখনও বাবা তরতর করে গাছে উঠে যান। পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে পারে. নিয়মিত ফুটবল খেলেন। সে কারণেই অ্যাঞ্জিওপ্লস্টি করার পরেও হাসপাতালের পাঁচ তলার দেওয়ালের কাঁচ ভেঙে দড়ি ধরে নিচে নেমে আসতে পেরেছেন। যদি না নামতে পারতেন, ভাবতেই পারছি না।” ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন ভাড়া বাড়ির মালিক অনন্যা দেবীও। খবর পেয়ে পড়শি অমিয় চট্টোপাধ্যায়ও চলে এসেছেন বুলা দেবীর বাড়িতে। অনন্যা দেবী বলেন, “সাংঘাতিক ঘটনা। অসুস্থতা সত্বেও বিকাশবাবু কীভাবে দড়ি বেয়ে নামলেন ভাবতেই পারছি না। ঘটনা শুনে বৌদি (বুলা দেবী) অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওঁকে ইসিজি করাতে নিয়ে যাব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.