বিদ্যুৎকর্মীদের গাড়ি গ্রামে ঢোকা রুখতে কেটে দেওয়া হত রাস্তা। হুকিং আটকাতে সংশ্লিষ্ট দফতর ব্যবস্থা নিতে গেলেই প্রতিবাদে সরব হতেন গ্রামের মানুষ। এ সবের জেরে বিদ্যুৎ চুরি রোখা সম্ভব হচ্ছিল না বাদুড়িয়ার রাজাপুর গ্রামে। শনিবার সেখানেই দেখা গেল উলট পুরান। বিদ্যুৎ কর্মীরা গ্রামে আসতেই তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন মানুষ। গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গেল অনেককে। স্থানীয় মানুষ নিজেরাই খুলতে শুরু করলেন হুকিংয়ের তার।
কোন জাদুতে সম্ভব হল এই ঘটনা?
বিদ্যুৎ চুরি রুখতে গ্রামে গ্রামে শিবির করে সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু হল এ দিন থেকে। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, এক দিনে গ্রামের ৫৬০ জন বিদ্যুতের সংযোগ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তাঁদের অনেকে সংযোগ পেয়ে গিয়েছেন এ দিনই। বিদ্যুৎ চুরি রুখতে এবং একই সঙ্গে সরকারের আয় বাড়াতে এই প্রকল্প বিশেষ কার্যকর হবে বলে সংস্থার কর্তাদের আশা। |
সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে হুকিং খুলতে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গণ্ডগোল বাধে পুলিশের। পুলিশের গুলিতে মারা যান দু’জন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় চলে গোটা রাজ্য জুড়ে। শুরু হয় রাজনৈতিক তরজা। ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য জুড়ে হুকিং-বিরোধী যে কর্মসূচি নেওয়ার কথা ছিল, তাতেও প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছে এই ঘটনার পরে। বহু এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, বিদ্যুতের জন্য আবেদন করে টাকা জমা দেওয়ার পরেও কেটে যায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। যার জেরে হুকিং করে সংযোগ নিতে বাধ্য হন অনেকেই। ‘ক্যাম্প কালেকশন’ (সিসিপি) প্রকল্পে আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই সংযোগ পাওয়া যাবে। রাজ্যে এই উদ্যোগ প্রথম বলে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বসিরহাট শাখার কর্তাদের দাবি। শনিবার থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হল বাদুড়িয়ার বাগজেলা পঞ্চায়েতের রাজাপুর, কানুপুর, বেনেরআটি, খাজরা, রায়পুর এবং রুয়েডাঙা গ্রামে। এখানে প্রায় বারো হাজার মানুষের বাস। আড়াই হাজারেরও বেশি বাড়ি। গ্রামগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ শেষ হলে তা বসিরহাট মহকুমার অন্যত্রও শুরু হবে বলে দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন।
শনিবার রাজাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা। নতুন প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বাস সর্বত্র। বাড়ি, দোকানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার জন্য আবেদনের হিড়িক। বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, মাত্র ৫ টাকার বিনিময়ে বিপিএল তালিকাভুক্তদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। দারিদ্র্যসীমার উপরের মানুষের জন্য এই খরচ ৩৮৪ টাকা। রাস্তার খুঁটি থেকে গ্রাহকদের বাড়ি পর্যন্ত তার, অ্যাঙ্গেল, মিটার এমনকী প্রয়োজনে বিদ্যুতের খুঁটিও লাগানো হবে এই টাকাতেই। এই এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতেই এত দিন হুকিং করে সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। মাছের চারা তৈরির জন্য বেশ কিছু হ্যাচারি আছে এখানে। সেখানে সর্ব ক্ষণ মোটর চলে। তা-ও এদ্দিন বেশিরভাগই চলত হুকিং করেই। নতুন প্রকল্পে এই সমস্যা অনেকটাই মিটবে বলে দাবি কর্তাদের। সংস্থা সূত্রের খবর, যাঁরা শিবিরে এসে আবেদন করছেন, তাঁদের দু’এক দিনের মধ্যেই সংযোগ দেওয়া হয়ে যাবে।
বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বসিরহাট শাখার আধিকারিক গৌতম সরকার বলেন, “এখানে তিনশো বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেব বলে আমরা তৈরি হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু শিবির শুরুর পরে দেখা যাচ্ছে ৫৬০টি পরিবার আবেদন করেছেন।” আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেক বাড়িতে এ দিন আইনি পথে বিজলি বাতি জ্বলেও গিয়েছে। স্বভাবতই খুশি আসুরা বিবি, শেফালি বিবিরা। তাঁদের কথায়, “বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার অফিসে গিয়ে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছিলাম। দালালের মাধ্যমে চেষ্টা করেও সংযোগ মেলেনি। বাধ্য হয়েই অনেকে হুকিং করত। এখন আইনি পথে বাড়িতে আলো-পাখা-টিভি চলবে। এতে অনেকেরই সুবিধা হবে।” কানুপুর গ্রামের হারানচন্দ্র ভাবক বলেন, “বিদ্যুৎ দফতরে গেলে নানা টালবাহানা করা হত। দালাল ধরতে হত অনেককে। তাতেও বহু মানুষ নানা ভাবে প্রতারিত হয়েছেন। বাড়ি বসে পরিষেবা পেয়ে সকলেই খুশি।”
সরকারি এই প্রকল্পে গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাল সাড়া পড়েছে বলে জানালেন স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, “প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বার বার অফিসে গিয়ে কোটেশন জমা দিয়েও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এর ফলে গ্রামের একটা বড় অংশই হুকিং করত। এখন গ্রামে গ্রামে শিবির করে যে ভাবে সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা হল, তাতে সকলেই সরকারি ভাবে বিদ্যুৎ নিতে চাইছে। এই প্রকল্পে খরচও যৎসামান্য।”
রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বসিরহাট ডিভিশনের ম্যানেজার প্রসূন ভৌমিক বলেন, “হুকিং করায় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার চল্লিশ শতাংশ টাকাও পাওয়া যায় না। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই গ্রামবাসীদের উৎসাহিত করতে এই প্রথম শিবির করে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা হল।” প্রসূনবাবুর বক্তব্য, এই প্রকল্পে এক দিকে যেমন বিদ্যুৎ চুরি কমবে, তেমনই সরকারি আয় বাড়বে। সেই সঙ্গে আরও বেশি সংখ্যায় মানুষ বৈধ উপায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন। |