|
|
|
|
আমরি-র অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের সেঞ্চুরি উৎসর্গ মনোজের |
অনন্ত চাপ ছিল বলেই আসল মনোজকে পাওয়া গেল |
দীপ দাশগুপ্ত |
বাউন্ডারির বাইরে লং-অফের উপর দিয়ে উড়ে গেল শটটা। টিভির সামনে বসে মুখ দিয়ে অজান্তে বেরিয়ে এল, ‘ব্রিলিয়ান্ট’! ৯০ থেকে ৯৬-এ গেল আমাদের মনোজ। টেনশন হচ্ছিল। কারণ ততক্ষণে যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যাচ্ছিল ওর। বোঝাই যাচ্ছিল, ক্র্যাম্প হচ্ছে। এই হচ্ছে সেই কঠিন পরিস্থিতি, যখন একজন ক্রিকেটারকে লড়তে হয় এক সঙ্গে অনেক কিছুর বিরুদ্ধে। যন্ত্রণা যদি প্রতিকূলতা হয়, সঙ্গে থাকে নার্ভাস নাইন্টির টেনশনও। ক্রিকেটীয় বায়োডেটায় একটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি কতটা দামি সেটা নিশ্চয়ই মনোজ জানত। এই সিরিজের এটাই ছিল শেষ ম্যাচ। মনোজের কাছে প্রথম, একমাত্র এবং শেষ সুযোগ। সেখানে পেশির টানের জন্য সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে আসার ছেলে ও নয়। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েও ঠিক সেঞ্চুরিটা করে গেল। টিভি-র সামনে বসে নিজেকে গর্বিত লাগছিল। নস্ট্যালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে পড়ছিল, মোহালিতে আমার টেস্ট সেঞ্চুরিটার কথা।
প্রথমেই বলে রাখি, যতই নিয়মরক্ষার ম্যাচ হোক, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যতই দুর্বল প্রতিপক্ষ হোক, মনোজের ইনিংসের তাৎপর্যটা অন্য জায়গায়। চেন্নাইয়ের উইকেট একেবারেই ব্যাটিংয়ের জন্য সহজ ছিল না। বল পড়ে নিচু হচ্ছিল, থমকে আসছিল। কিন্তু মনোজকে দেখে এক বারও মনে হয়নি এই উইকেটে রান করা আদৌ ক্রিকেটের সহজতম কাজগুলোর একটা নয়। বিরাট কোহলি উল্টো দিকে খেলছিল ঠিকই। ভারত ম্যাচটা জিতল ঠিকই, পোলার্ডের ১১৯ ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে মনে রাখার মতো কিছু নেই। মনোজই প্রত্যাশা মতো ম্যাচের সেরা।
|
|
চেন্নাইয়ে মনোজ তিওয়ারির ছবি: রয়টার্সের |
ওর মতো অনন্ত চাপ আজ কাউকে নিতে হয়নি। এই ম্যাচে রান না পাওয়া মানেই অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান ডে টিম থেকে নাম কাটা যেত। পিছিয়ে যেতে হত বছরখানেক। কেরিয়ারের সম্ভাবনা নিয়েই একটা প্রশ্ন উঠে পড়ত। এই জায়গা থেকে বিচার করতে হবে মনোজের ১০৪। মনে রাখতে হবে, চার বছর আগে ছেলেটা জাতীয় দলের দরজা খুলেও ফিল্ডিং করতে গিয়ে চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিল। তার এক বছর পরে এসেছিল আর একটা সুযোগ। তা-ও কি না অস্ট্রেলিয়ায় নামার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেমে পড়তে হয়েছিল ব্রেট লি-র বিরুদ্ধে। ব্যর্থতা এবং পরের সুযোগটা আসতে লাগল তিন বছর। ইডেনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে-টায় রান না পাওয়ার পর অনেককে ওর ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিতে দেখেছি। কিন্তু আমি জানতাম, মনোজ পারবে।
কেন? মনোজ কিন্তু খুব প্রতিভাবানদের দলে পড়ে না। ওর থেকে প্রতিভাবান ক্রিকেটার আমি দেখেছি। আসলে ও নিজের খেলাটা জানে, বোঝে। মানে, নিজের খেলার যেটা জোরাল দিক সেটা খুব ভাল করে বিচার করতে পারে। কোন শটটা ওর খেলা উচিত বা উচিত নয়, তা নিয়ে স্বচ্ছ একটা ধারণা আছে। দ্বিতীয়ত, নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে ও অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী। ও যেটা ভাবে, সেটাই করে। তাতে কে কী ভাবল তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। একটা উদাহরণ দিই। দলীপ ট্রফির একটা ম্যাচ। আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। মনোজ বাদ পড়ার পর আমাকে সোজাসুজি এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন ও টিমে নেই। কেউ কেউ এটাকে ঔদ্ধত্য বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু মনোজ কোনও রাখঢাকে বিশ্বাস করে না। স্পষ্ট কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে জানে। তার জন্য কখনও কখনও সমস্যা হয় না তা নয়। অহেতুক বিতর্কের মধ্যে জড়াতে হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। মনোজ এই রকমই। ওর ক্রিকেটটাও এই ধাঁচের।
অল্প কথায়, ওকে বোঝাতে গেলে তিনটে ইংরেজি শব্দ বলব। অ্যাগ্রেসিভ। হার্ড ওয়ার্কিং। ফোকাস্ড। আগ্রাসনের কথা বলি। ওয়াংখেড়েতে ২০০৮-এর রঞ্জি ফাইনাল। আমরা বনাম মুম্বই। মুম্বই মানে সচিন তেন্ডুলকর, জাহির খান, অজিত আগরকর, অমল মুজুমদার ইত্যাদি ইত্যাদি। মনোজ যখন দুর্দান্ত ইনিংসটা খেলছিল, উল্টো দিকে আমি যতটা সময় ছিলাম, দেখছিলাম কী হচ্ছিল। ক্রমাগত চলছিল স্লেজিং। জাহির-আগরকররা প্রত্যেক ওভারের পর মনোজের জন্য ‘বাণী’ দিচ্ছিল। মনোজও তেমনই পাল্টা দিচ্ছিল। এগিয়ে এসে এক বার জাহিরকে মিডঅফের উপর দিয়ে তুলে দিল। এক বার ভাবলাম মনোজকে গিয়ে বলি, মাথা গরম করিস না। দেখে খ্যাল। পরের বলটাও গেল বাউন্ডারির বাইরে। তখনই বুঝেছিলাম, আমি কী বলি তাতে কিছু এসে যায় না। ওর আত্মবিশ্বাসটা এত বেশি যে কারও কথা শুনবে না। সে জন্যই যত দিন ক্যাপ্টেন ছিলাম, কোনও দিন ওর উপর কিছু চাপিয়ে দিইনি।
আরও যেটা বলার, মনোজ সব সময় ‘প্রেশার সিচুয়েশন’-এ ব্যাট করতে ভালবাসে। যত কঠিন হবে পরিস্থিতি, যত মনে হবে কাজটা অসম্ভব, তত জেদ চাপবে ওর। তত খেলা খুলবে। যে কোনও ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রে এটা অনন্য একটা গুণ। সফল হওয়ার খুব জরুরি একটা শর্ত। অনন্ত চাপ ছিল বলেই আসল মনোজকে পাওয়া গেল। এই ইনিংসের পরে ওকে অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়ান ডে সিরিজের টিমে সুযোগ না পেলে অবাক হব। আর ওই সিরিজে সুযোগ পেয়ে যদি ভাল কিছু করতে পারে, ওর আন্তর্জাতিক কেরিয়ার একটা অন্য মাত্রা পাবে। বাংলা ক্রিকেটের পক্ষেও এই ১০৪ এক ঝলক টাটকা বাতাস। তরতাজা এবং নতুন কিছুর গন্ধে ভরপুর। বেশ কঠিন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলা। সেখানে পরের দিল্লি ম্যাচ থেকে মনোজকে পাওয়া যাবে। এ-ও জানি, বাংলাকে বাঁচাতে নিজেকে উজাড় করে দিতে চাইবে ও।
|
চেন্নাইয়ের স্কোরবোর্ড |
ভারত
|
গম্ভীর এলবিডব্লিউ মার্টিন ৩১
রাহানে এলবিডব্লিউ রোচ ০
পার্থিব বো রোচ ০
মনোজ আহত অবসৃত ১০৪
বিরাট ক স্যামুয়েলস বো মার্টিন ৮০
রোহিত বো নারায়ণ ২১
রায়না ন.আ. ১৬
ইরফান রান আউট ৪
অতিরিক্ত ১১
মোট (৫০ ওভারে) ২৬৭-৬।
পতন: ১, ১, ৮৪, ২৪১, ২৫০, ২৬৭।
বোলিং: রোচ ৮-০-৪৬-২, রাসেল ৬-০-৩১-০, নারায়ণ ১০-১-৪১-১, স্যামি ৫-০-২৮-০
মার্টিন ১০-০-৪৭-২, স্যামুয়েলস ৯-০-৫৪-০, পোলার্ড ২-০-১৪-০।
|
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
|
সিমন্স এলবিডব্লিউ ইরফান ০
পাওয়েল বো ইরফান ১৫
স্যামুয়েলস ক পার্থিব বো মিঠুন ৬
মহম্মদ এলবিডব্লিউ মিঠুন ২
রামদিন এলবিডব্লিউ জাডেজা ১৪
পোলার্ড ক রাহানে বো রায়না ১১৯
রাসেল রান আউট ৫৩
স্যামি ক রাহানে বো জাডেজা ৩
নারায়ণ বো রাহুল ৮
রোচ বো জাডেজা ০
মার্টিন ন.আ. ০
অতিরিক্ত ১৩
মোট (৪৪.১ ওভারে) ২৩৩।
পতন: ০, ২৩, ২৯, ৩৬, ৭৮, ১৬৭, ১৮১, ১৯৫, ২১৩।
বোলিং: ইরফান ৯-১-৪২-২, মিঠুন ৭-১-৩২-২, রায়না ৬.১-০-২৪-১, জাডেজা ১০-০-৬২-৩
রাহুল ১০-০-৪৫-১, মনোজ ১-০-১৫-০, বিরাট ১-০-১১-০। |
|
|
|
|
|
|
|