ভারত-৪ (সুনীল-পেনাল্টি, ক্লিফোর্ড, জেজে, সুশীল)
আফগানিস্তান-০
|
স্বদেশে যুদ্ধ বিধ্বস্ত! বিদেশে মাঠের যুদ্ধেও আফগানিস্তান সাফ ফাইনালের একটা সময় যুদ্ধংদেহি হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ভারতের অনুকূলে একটি পেনাল্টি দেওয়া নিয়ে রেফারির উপর চড়াও হন আফগান ফুটবলাররা। তখনও ম্যাচে কোনও গোল হয়নি। গোলকিপার হামিদুল্লা রেফারিকে ধাক্কা দিলে তাঁকে লাল কার্ড দেখানো হয়। শেষ প্রায় আধ ঘণ্টা দশজনে খেলে আফগানিস্তান। ডিফেন্সের শেষ প্রহরীকে হারানোয় আরও মাথা গরম হয়ে ওঠা দুই আফগান ডিফেন্ডার রেফারিকে গালাগাল দিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন। পুরো আফগান রিজার্ভ বেঞ্চ প্রতিবাদে সাইউলাইনের নিষিদ্ধ এরিয়ায় চলে আসে। পাঁচ মিনিট খেলা বন্ধ পর্যন্ত রাখতে হয় হতভম্ব সংগঠকদের। খেলা ফের শুরু হলে প্রতিদ্বন্দ্বীর তাল কেটে যাওয়া অবস্থার পুরো ফায়দা তোলেন সুনীল ছেত্রী-রহিম নবিরা। সুনীল দ্বিতীয় বার নেওয়া পেনাল্টি থেকে ৭১ মিনিটে ভারতকে এগিয়ে দেওয়ার পর শেষ ২০ মিনিটে খেই হারিয়ে ফেলা আফগানদের জালে আরও তিন বার বল ঢোকায় ভারত।
প্রতিদ্বন্দ্বী দল দশ জন হয়ে যাওয়ার পর স্যাভিও মেদেইরার ছেলেদের ফাইনালে সব ক’টা গোল। তা সত্ত্বেও সাফের সংসারে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও কথা হবে না। ন’বছর বয়স্ক সাফ কাপে আট বার ফাইনাল খেলে এ দিন নিয়ে ছ’বার চ্যাম্পিয়ন হল দক্ষিণ পূর্ব এশীয় ফুটবলের বড় দাদা ভারত।
|
ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা নিয়ে মাথায় ফেট্টি বাঁধা নবি ও তাঁর সতীর্থরা জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামের হাজার পনেরো দর্শকের গ্যালারির দিকে ছুটে যান। সূনীল থেকে জেজে, ক্লাইম্যাক্স থেকে গাউলিপুরো টিম দু’হাত তুলে অভিনন্দন নেন দর্শকদের। তার পরেই দৌড়ে গিয়ে সব ফুটবলার জড়িয়ে ধরেন কোচ স্যাভিওকে। ভাইচুং-যুগোত্তর ভারতীয় দলের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ই শুধু নয়, জাতীয় কোচ হয়ে প্রথম টুর্নামেন্টেই বাজিমাত স্যাভিওরও।
আর সুনীল ছেত্রী? তিনি তো টুর্নামেন্টের প্রায় সব ক’টা পুরস্কারই নিয়ে গেলেন। সর্বোচ্চ গোলদাতা। সবচেয়ে মূল্যবান প্লেয়ার (এমভিপি)। ফেয়ার প্লে ট্রফিসব। তবু সেরা পুরস্কার বোধহয় এর কোনওটা নয়। সেটা হল, টুর্নামেন্টে ভারতের পাঁচটা ম্যাচেই সেরার পুরস্কার পাওয়া। গ্রুপে আগানিস্তান থেকে ফাইনালে ফের আফগানিস্তান। পাঁচ ম্যাচে পাঁচ বারই ম্যান অব দ্য ম্যাচ এই বেঁটেখাটো ভারতীয় স্ট্রাইকার। সুনীলের কৃতিত্ব আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে সম্ভবত বিরল। গ্লাসগো রেঞ্জার্সের ট্রায়ালে ব্যর্থতার দুঃখ দেশে ফিরেই সাফ কাপে যেন সুদে-আসলে মিটিয়ে নিলেন সুনীল। সুনীল-নবিদের সাফল্যকে স্বীকৃতি জানাতে কার্পণ্য দেখায়নি ফেডারেশনও। চ্যাম্পিয়নশিপের ৫৫ লাখ টাকা প্রাইজমানি ভারতীয় দলের সব সদস্যের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া ছাড়াও এ দিনই এআইএফএফ জাতীয় দলের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ধোষণা করে দিল।
ফাইনালে প্রতিপক্ষকে চার গোলে চূর্ণ করবে ভারত, সেটা কিন্তু ক্লিফোর্ড মিরান্ডা-গৌরমাঙ্গিদের প্রথমার্ধের খেলা দেখে বোঝা যায়নি। বরং তখন ভারত প্রায় কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তানের পাসিং গেমের কাছে। ঘরের মাঠে ফেভারিট দলকে এমন অবস্থায় পেয়েও আফগানরা গোল করতে পারেননি কিছুটা নিজেদের অনভিজ্ঞতার কারণে ও কিছুটা গোলকিপার করণজিতের দৃঢ়তায়। এই সময়ই দিনের সহজতম সুযোগটি নষ্ট করেন আরেজো। উল্টো দিকে ভারতের আক্রমণগুলি আফগানের আফগানিস্তানের দুই লম্বা স্টপারের কাছে আটকে যাচ্ছিল বারবার।
বিরতির পর স্যাভিও স্ট্র্যাটেজি পাল্টে লং বলের পরিবর্তে মাটিতে বল রেখে ছোট পাসে খেলান দলকে। হাতেনাতে ফল। পরপর দু’টো সুযোগ জেজে নষ্ট করার পর ৬৩ মিনিটে জেজেকেই স্টপার ফয়জল ল্যাং মেরে ফেলে দেন বক্সের মধ্যে। রেফারি পেনাল্টি দিতে ভুল করেননি। যা নিয়ে পরের বেশ কিছুক্ষণ মাঠে তুলকালাম আফগানদের। তার পর সুনীল পেনাল্টি থেকে গোলে বল পাঠালে সেটাও নাকচ হয় এক ভারতীয় ফুটবলার শট মারার সময় বক্সের ভেতর ঢুকে পড়ায়। দ্বিতীয় বার আবার শট নিয়ে সুনীল জালে বল পাঠিয়ে ভারতকে ১-০ এগিয়ে দেন।
পরের ১৯ মিনিটে আরও তিন গোল। ভারত তখন একতরফা মাঠ শাসন করছে। গৌরমাঙ্গি-সুনীল-হয়ে বল পেয়ে ক্লিফোর্ড ২-০ করেন। মিনিট দুই পরে ফের সুনীলের পাস থেকে এ বার জেজে তৃতীয় গোলটি করেন। আর ইনজুরি টাইমে বক্সের মাথা থেকে দুর্দান্ত ভলিতে শেষ গোল সুনীলের পরিবর্তে নামা সুশীল সিংহের।
উচ্ছ্বসিত স্যাভিও বললেন “আমাকে বাড়তি আনন্দ দিচ্ছে ফুটবলার ও কোচ দুই ভূমিকাতেই এই ট্রফি জিতলাম বলে। ছেলেরা প্রায় বিনা প্র্যাক্টিসে টুর্নামেন্ট খেলল। তবু আমরা মাত্র দু’গোল খেয়েছি গোটা টুর্নামেন্টে।” আর শান্ত সুনীল ছেত্রী বললেন, “আমার এতগুলো পুরস্কারের মুল্যই থাকত না যদি না আমরা চ্যাম্পিয়ন হতাম।” ভারতীয় ফুটবলে কি ভাইচুংয়ের জায়গা নিলেন? প্রশ্ন হলে সুনীল বললেন, “কেউ কারও জায়গা নেয় না। ভাইচুং ভাই আমাদের সব সময় অনুপ্রাণিত করত। এখন দলের সিনিয়র হিসাবে আমিও তাই করছি জুনিয়রদের।” দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সুনীলকে অবশ্য মোহনবাগান কবে পাবে ঠিক নেই। কেননা, গোড়ালির চোটের এম আর আই করিয়ে রিপোর্ট ভাল হলে তবেই তিনি ক্লাবে যোগ দেবেন।
ভারত: করণজিৎ, নির্মল, মহেশ, গৌরমাঙ্গি, নবি, অ্যান্টনি (স্টিভন), ক্লাইম্যাক্স, ক্লিফোর্ড (লালরেনডিকা), রোকাস, জেজে, সুনীল (সুশীল)।
|
সুনীল নজির |
• সাফ ফুটবলে একটি সংস্করণে সর্বাধিক গোল করলেন সুনীল ছেত্রী। ৫ ম্যাচে ৭ গোল।
• সুনীল ভাঙলেন আই এম বিজয়নের (৬ গোল) রেকর্ড।
• চার বার সাফ কাপ খেলে সুনীল ১০ ম্যাচে ৯ গোল করেছেন।
• আন্তর্জাতিক গোল করার তালিকায় ভারতীয়দের মধ্যে সুনীল এখন তিন নম্বরে।
৬৩ ম্যাচে ৩৬ গোল। শীর্ষে ভাইচুং, ১০৭ ম্যাচে ৪৩ গোল। দ্বিতীয় বিজয়ন, ৮৬ ম্যাচে ৪১ গোল।
• এ বারের টুর্নামেন্টে ভারতের পাঁচটি ম্যাচেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ সুনীল।
|
পরিসংখ্যান: হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় |
|