রাজনৈতিক হিংসার বাতাবরণ অপরিবর্তিত গোঘাটের গ্রামে
স্কুল পরিচালন কমিটির ভোটকে কেন্দ্র করে গোঘাটের শ্যাওড়া গ্রামে তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনায় ২৮ জন অভিযুক্তের মধ্যে এখনও পর্যন্ত তিন জনকে ধরেছে পুলিশ। গত শুক্রবার ওই ঘটনায় ধৃতদের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা মদন ঘোষও আছেন। অন্য দু’জন তৃণমূলেরই সক্রিয় কর্মী মেহবুব চৌধুরী এবং সহদেব পাল।
গোঘাটের এই এলাকায় রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাস প্রাচীন। রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের পরেও যার কোনও ‘পরিবর্তন’ হয়নি। সত্তরের দশক থেকে এলাকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হাতে গোনা কয়েক জন বাদে সকলেই নানা সময়ে দলবদল করেছেন। শুক্রবারের ঘটনায় নিহত শেখ নঈমুদ্দিনও এক সময়ে সিপিএমের শিবিরেই ছিলেন। দলের গোঘাট জোনাল কমিটির সম্পাদক অভয় ঘোষের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে তাঁর পরিচিতি ছিল। লোকসভা ভোটের পর তিনি তৃণমূলে যান। গোঘাট ১ ব্লক তৃণমূল স্টিয়ারিং কমিটির ছয় সদস্যের এক জন ছিলেন নঈমুদ্দিন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ভূমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শ্যাওড়ায় সংঘর্ষের সূত্রপাত। আরামবাগ মহকুমায় প্রথম ভূমি আন্দোলন গড়ে ওঠে শ্যাওড়া ও নকুন্ডা গ্রামে। নকুন্ডার বাসিন্দা তথা প্রয়াত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মৃণাল ঘোষের নেতৃত্বে ষাটের দশকে দলকার জলাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা। সে সময়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের জেরে জলার প্রায় ২২০০ একর জমির পাট্টা বিলি হয় দরিদ্র মানুষের মধ্যে। এই ‘সাফল্যে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃত্বেই স্থানীয় কয়েক জন বড় রায়তের জমিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন দানা বাঁধে। শ্যাওড়া গ্রামের নিরুপমা ভান্ডারি, অনিল ভান্ডারি, শ্যাওড়া পঞ্চায়েতেরই আসলহরি গ্রামের লক্ষ্মীকান্ত ঘোষ পরিবারের অধীনে ছিল শ্যাওড়া, বেলে, বলরামপুর, কুসুমা, জ্যোত মহব্বত, আমডোবা, গোয়ালপাড়া, মুক্তারপুর প্রভৃতি মৌজার বিশাল এলাকা। সেই জমিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে ১৯৭৬ সালে এই এলাকায় প্রথম খুন হন শ্যাওড়া গ্রামের ফণীন্দ্রনাথ পোড়েল নামে এক ফরওয়ার্ড ব্লক সমর্থক। ১৯৭৭ সালে বাম সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত গোঘাট ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতি এবং সব ক’টি পঞ্চায়েত ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের দখলে। দলের কর্মী-সমর্থকদের বহু জমির পাট্টা দেওয়া হয়। কংগ্রেসের তখন স্তিমিত দশা। সিপিএমেরও ‘উত্থান’ হয়নি এই এলাকায়।
১৯৮০ সালে কোন আরামবাগ কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী বিজয় মোদকের কাছে পরাজিত হন কংগ্রেস নেতা প্রফুল্ল সেন। তারপর থেকেই এই মহকুমায় ‘জমি’ পেতে শুরু করে সিপিএম। গোঘাটেও প্রভাব বাড়তে থাকে তাদের। কংগ্রেসের একটা বড় অংশ সিপিএমের সঙ্গে চলে যায়। কংগ্রেস ছেড়ে সে সময়েই সিপিএমে যোগ দেন ভরত ঘোষ। পরে তিনি সিপিএমের গোঘাট লোকাল কমিটির সম্পাদকও হন। ১৯৮২ সাল নাগাদ জমিকে কেন্দ্র করেই ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সিপিএমের সম্পর্কের পারদ চড়তে থাকে। দু’পক্ষের মধ্যে সে সময় থেকেই শুরু হয় বোমা-গুলির নিরন্তর লড়াই। ফরওয়ার্ড ব্লকের একটা অংশ মিশে যায় সিপিএমে। গোঘাটের বর্তমান বিধায়ক ফরওয়ার্ড ব্লকের বিশ্বনাথ কারক সে সময়েও ছিলেন ওই দলের সঙ্গেই। ১৯৮৩ সালে তিনিও সিপিএমে যোগ দেন। শ্যাওড়া পঞ্চায়েতের প্রধানও হন। ওই বছরই এলাকার বেশির ভাগ পঞ্চায়েতের দখল নেয় সিপিএম। ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী-সমর্থকদের হাতে থাকা জমি কেড়ে নিয়ে সিপিএম নিজেদের লোকজনের মধ্যে বিলি শুরু করে বলে অভিযোগ। যা নিয়ে দুই বাম শরিকের সংঘর্ষ চলতেই থাকে। পরবর্তী বছর সাতেকের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী তারাপদ সাঁতরা (কুসুমা গ্রামের বাসিন্দা) এবং শাহ আলম (বর্মা গ্রামের বাসিন্দা) খুন হন।
১৯৯৩ সালে বিশ্বনাথ কারক ফরওয়ার্ড ব্লকে ফিরে যান। কিন্তু থেকে যান শ্যাওড়া পঞ্চায়েতের প্রধানের পদে। সে সময়ে ফরওয়ার্ড ব্লক সিপিএমের হাতে চলে যাওয়া বহু পঞ্চায়েতে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে। কয়েক মাসের মধ্যে জমি ‘পুনর্দখল’ও শুরু হয়। তবে এলাকায় তখনও সিপিএম যথেষ্ট প্রভাবশালী। ২০০১-২০০২ সালে দু’বার গুলিবিদ্ধ হন বিশ্বনাথবাবু। ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী-সমর্থকেরা ক্রমে গ্রামছাড়া হতে থাকেন। ২০০৩ সাল নাগাদ সিপিএমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে এই এলাকায়। ভরত ঘোষ ও অভয় ঘোষের নেতৃত্বে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয় মারামারি। ফলে, রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাসে শ্যাওড়ায় অতি পুরনো। নিছক পারিবারিক বিবাদও এখানে রাজনৈতিক রঙ নেয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোরাটা এলাকায় ‘অস্বাভাবিক’ কিছু নয়, তা মেনে নিয়েছে সব রাজনৈতিক দলগুলিই। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে গোঘাটের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর অস্ত্র মিললেও শ্যাওড়া থেকে পাওয়া যায়নি কিছুই।
রাজ্য রাজনীতিতে সাম্প্রতিক ক্ষমতা বদলের পরেও গোঘাটে গোলমালের চিত্রটা বদলায়নি। বিশ্বনাথ কারক গোঘাটে ফরওয়ার্ড ব্লকের টিকিটে জয়ী হয়ে বিধায়ক হলেও বাম কর্মী-সমর্থকদের বেশির ভাগই এখন মিশে গিয়েছে তৃণমূল শিবিরে। বন্ধ হয়নি রাজনৈতিক হানাহানি। শুক্রবারের ঘটনা যা ফের প্রমাণ করে দিল। ফরওয়ার্ড ব্লক-সিপিএমের মারামারি কিংবা সিপিএমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে যুক্ত লোকজনই এখন তৃণমূলের আশ্রয়ে ফের নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও মনে করছে। যার জেরে তৃণমূলও এখন একাধিক গোষ্ঠীতে ভেঙে গিয়েছে। সে কথা বিলক্ষণ জানেন দলের নেতারা। যে স্কুলের (শ্যাওড়া ইউনিয়ন হাইস্কুল) সামনে খুন হয়েছিলেন নঈমুদ্দিন, ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির ভোটে ইতিমধ্যেই ৬টি আসনে মনোনয়ন দাখিল করেছিল তৃণমূলের এক পক্ষ। নঈমুদ্দিন শুক্রবার নিজের পছন্দের লোকজন নিয়ে স্কুলে যান পাল্টা মনোনয়ন দাখিল করতে। আরামবাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা তথা চুঁচুড়ার বিধায়ক তপন মজুমদার বলেন, “দলে কোনও গোষ্ঠীকোন্দল বরদাস্ত করা হবে না। সকলকে ঐক্যবন্ধ ভাবে রাজনীতি করতে হবে।”
নঈমুদ্দিন খুনে সিপিএম-ফব নেতা-কর্মীরা যুক্ত বলে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। কিন্তু যে ২৮ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে পুলিশের কাছে, তাদের মধ্যে ১২ জন বাদে বাকিরা সকলেই তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর! বামেদের ১২ জন অভিযুক্তের তালিকায় আছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক বিশ্বনাথ কারক-সহ ওই দলের চার জন। সিপিএম নেতা ভরত ঘোষ, দেবু চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর রায়, পঞ্চায়েত প্রধান সন্তোষ পণ্ডিত-সহ ৮ জন। এঁদের দাবি, ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই জড়িত নন তাঁরা। এ বিষয়ে তপনবাবুর বক্তব্য, “আমি বিধানসভায় প্রসঙ্গটি তুলব। সিআইডি তদন্তের দাবি করব। খুনি বা খুনের ষড়যন্ত্রকারী যে বা যারাই হোক, তাদের গ্রেফতার করা হবে। খুনিদের কোনও রাজনৈতিক তকমা দেখা হবে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.