দিন-রাত চলছে মাটি কাটার কাজ। মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে ক্রমশ ভাগীরথীর গর্ভে চলে যেতে বসেছে দু’টি গ্রাম। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি। এমনই অভিযোগ কালনার কৃষ্ণদেবপুর পঞ্চায়েতের কলডাঙা ও নতুনচর গ্রামের বাসিন্দাদের। তাঁদের আরও ক্ষোভ, মাটি মাফিয়াদের কারবার বন্ধ করতে যথেষ্ট উদ্যোগী নয় প্রশাসন। প্রশাসনের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, অবৈধ কারবার বন্ধে চেষ্টা চলছে। শনিবারই নতুনচর এলাকা থেকে মাটি কাটা ও পাচারের অভিযোগে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ভাগীরথীর পাড়ের এই দু’টি গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার পেশা চাষাবাদ। ভাগীরথীর ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার খেত জমির মধ্যে কাঁচা রাস্তা ধরে এগোলে কলডাঙা গ্রামে পৌঁছনো যায়। আবার ঘাট থেকে এগিয়ে ওই জমির ডান দিকে একটি মেঠো রাস্তা গিয়েছে নতুনচর গ্রামে। গ্রামবাসীর অভিযোগ, বহু বছর ধরেই বেআইনি ভাবে নদীপাড় ও সংলগ্ন চাষযোগ্য জমির মাটি কেটে নেওয়া চলছে। এর ফলে দুই গ্রামের অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে ভাগীরথী। বাসিন্দাদের দাবি, এলাকার অনেকে আবার নিজেদের জমির মাটি কেটে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেন। এর জেরে আশপাশের জমিগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, কোনও জমির মাটি কাটতে হলে তার চার পাশে তিন-চার ফুটের একটি গর্ত করা হয়। মাটি কেটে তুলে নেওয়ার পরে নদী দ্রুত সেই এলাকা গ্রাম করে। এর ফলে জমি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আশপাশের খেতের মালিকেরাও মাটি বিক্রির পথ ধরেন। তাতে সমস্যা আরও বেড়ে চলেছে। এগিয়ে আসছে ভাগীরথী।
কলডাঙা ও নতুনচর গ্রামে ঢোকার মুখে রবি মরসুমে সর্ষে ও নানা ধরনের সব্জি চাষ হয়েছে। গ্রামবাসীরা জানান, নদী থেকে সেচের জল মেলায় এই খেতে সারা বছর ধরেই নানা ফসলের চাষ করা যায়। নদীপথ ধরেই ফসল বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কলডাঙা-নতুনচর গ্রামোন্নয়ন সমিতির সদস্য আলি আকবর প্রধান বলেন, “যে ভাবে লাগাতার মাটি কাটা হচ্ছে, ভবিষ্যতে চাষের জন্য কোনও জমি পড়ে থাকবে কি না সন্দেহ রয়েছে। পাশাপাশি দু’টি গ্রাম ভগীরথীর গর্ভে চলে যেতে পারে।” পাড়ের মাটি কাটার জেরে নতুনচর গ্রামে ঢোকার রাস্তাটিও সঙ্কটে, দাবি তাঁর। |
কী ভাবে মাটি কাটছে মাফিয়ারা? স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গভীর রাত থেকে দলে দলে নৌকায় করে পাড়ে এসে হাজির হয় মাটি কাটার লোকজন। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে নৌকায় বোঝাই করে নিয়ে যায় তারা। কোনও কোনও দল আবার প্রকাশ্যে দিনের আলোতেই এই কাজ করে। কাটা মাটি ইটভাটা-সহ নানা জায়গায় চড়া দামে বিক্রি হয়। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এর বিরুদ্ধে সরব হলে হুমকির মুখে পড়তে হয়। গত ২৬ নভেম্বর কলডাঙা-নতুনচর গ্রামোন্নয়ন সমিতির সচিব রসিদ মণ্ডল কালনা থানায় লিখিত অভিযোগে জানান, গ্রামের কয়েক জনকে নিয়ে তিনি এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মাটি মাফিয়ারা কর্ণপাত করেননি, উল্টে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয় বলে তাঁর অভিযোগ। ২৮ নভেম্বর রসিদ মণ্ডল একই অভিযোগপত্র কালনার মহকুমাশাসকের অফিসে। ওই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করে করেছেন এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য আশাদুল শেখ-সহ সমিতির সদস্যেরা। আশাদুল বলেন, “পাড়ের মাটি কাটা বন্ধ না করা গেলে দু’টি গ্রামকেই রক্ষা করা যাবে না। পুলিশ-প্রশাসনের এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া উচিত।”
মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি বলেন, “ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ওই দু’টি গ্রামে লাগাতার পুলিশি অভিযানে সমস্যা রয়েছে। সাত সদস্যের একটি দল এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। তাঁরা রিপোর্ট দেওয়ার পরেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কালনা থানার তরফেও জানানো হয়, ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এ দিকে, শনিবার বেআইনি ভাবে মাটি কাটা ও পাচারের অভিযোগে কুমারেশ বিশ্বাস নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বাড়ি কালনা শহর লাগোয়া হাসপুকুর এলাকায়। রবিবার ধৃতকে কালনা মহকুমা আদালতে তোলা হলে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়। |