জমি-জটে আটকে গিয়েছে জেলা মুখ্য নিয়ন্ত্রিত বাজারের ভবিষ্যৎ।
বর্ধমান দেওয়ানি আদালতের নির্দেশ মতো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সামর্থ্য নেই জানিয়ে হাইকোর্টে গিয়েছে জেলা প্রশাসন। ফলে এক দিকে চাষিরা যেমন ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্য দিকে সরকারি আধিকারিকদের পরস্পরবিরোধী কথায় জমিদাতারা বিভ্রান্ত। আগামী মার্চের মধ্যে দোকান ও চাষিদের বিশ্রামের ভবন-সহ বাজার গড়ার কাজ শুরু না হলে নির্মাণের জন্য বরাদ্দ টাকা ফেরত চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরির জন্য ২০০৬ সালে বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে আলিশা মৌজায় ৯.১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ওই জমিতে বাজার গড়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যে দু’দফায় মোট ২ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা এসেছে। কিন্তু কাজ শুরু করা যায়নি। কারণ, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’তে জমি মালিকেরা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। গত বছরের গোড়ার দিকে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়।
সম্প্রতি ওই আদালত রায় দিয়েছে, অধিগৃহীত জমির জন্য একর পিছু অতিরিক্ত চার লক্ষ টাকা এবং শতকরা ৯ ভাগ সান্ত্বনা ভাতা দিতে হবে। যত দিন তা না দেওয়া হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত বছরে ১৫ শতাংশ হারে সুদও দিতে হবে। এই রায়ে সমস্যায় পড়ে গিয়েছে প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) শ্যামল মণ্ডল বলেন, “বর্ধমান আদালতের রায় মানতে হলে অতিরিক্ত ৬ কোটি টাকা দিতে হবে চাষিদের। সেটা কার্যত অসম্ভব। প্রকল্পের জন্যই তো আমরা ওর চেয়ে অনেক কম পেয়েছি। এত টাকা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ওই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছি।” |
শ্যামলবাবুই ওই নিয়ন্ত্রিত বাজার কমিটির চেয়ারম্যান। কিন্তু কমিটির সম্পাদক তথা কৃষিজ বিপণন দফতরের সহকারী অধিকর্তা প্রিয়দর্শী সেনের সঙ্গে তাঁর বয়ান মিলছে না। প্রিয়দর্শীবাবু বলেন, “গত ৩ নভেম্বর ভাতারের বিধায়ক বনমালী হাজরার নেতৃত্বে বিধানসভার স্থায়ী কমিটি দেওয়ানি আদালতের রায় মেনে নিতে সুপারিশ করে যায়। ওই টাকা দিতে আমরা রাজি হয়েছি। অতিরিক্ত টাকা যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য আমার দফতরকে চিঠিও লিখেছি। বর্ধমান আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে আমরা আদালতে যে মামলা করেছি, তা তুলে নেব। তারই পাশাপাশি দ্রুত ওই জমিতে নির্মাণ শুরু করতে চাইছি।”
এর পরেও কেন কাজ শুরু করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিধায়ক। বনমালীবাবু বলেন, “আমি প্রশাসনকে বলেছিলাম, চাষিদের সঙ্গে অলোচনা করে কাজটা শুরু করতে। সেটা এখনও হয়নি কেন, তা নিয়ে কথা বলতে হবে।” প্রিয়দর্শীবাবু জানান, তাঁরা ইতিমধ্যেই চাষিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নির্মাণ শুরু হয়ে গেলেই বাড়তি টাকা দেওয়া শুরু হবে চাষিদের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু টাকা হাতে না পেলে কাজ শুরু করতে দেবেন না বলে চাষিরা জানিয়ে দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে তাঁদের কর্মীরা নির্মাণের মাপজোক করতে গেলে চাষিরা তাঁদের ভাগিয়ে দেন। প্রশাসনের ডাকা বৈঠকেও তাঁরা যাননি।
প্যামরা ও আলিশা নামে স্থানীয় দু’টি গ্রামের ৩০ জন চাষি এই প্রকল্পের জন্য জমি দিয়েছেন। প্যামরার বাসিন্দা জয়ন্ত ঘোষ বলেন, “শুধু অতিরিক্ত দাম নয়, আমরা চাকরি অথবা নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ চেয়েছি। চেয়েছি, প্রকল্পে তৈরি হওয়া দোকানঘরের একটি করে চাষিদের দেওয়া হোক। কিন্তু প্রশাসন তো অতিরিক্ত দাম দিতেই নারাজ!” প্যামরার চাষি কার্তিক চক্রবর্তীর কথায়, “আদালত অতিরিক্ত দাম দিতে বলেছে। তবু প্রশাসন নারাজ। উল্টে মামলা করেছে হাইকোর্টে। ওদের কী করে বিশ্বাস করব? এক অফিসার বলছেন, অতিরিক্ত দাম দেওয়া হবে। অন্য জন বলছেন, দেওয়া হবে না!” জমিদাতাদের দাবি, তাঁদের পিছনে কোনও রাজনৈতিক দল নেই। তবে সিপিএম এই পরিস্থিতির জন্য তৃণমূলকে দায়ী করেছে। সিপিএম নেতা প্রদীপ তায়ের অভিযোগ, “২০০৯ থেকেই এই জমিতে নির্মাণে বাধা দিতে শুরু করেন স্থানীয় চাষিরা। তার আগে কোনও সমস্যা ছিল না। এই চাষিদের তখন সমর্থন করছিল তৃণমূল। চাষিদের বাড়তি দামের দাবি মানা সম্ভব হয়নি। তাই নির্মাণও শুরু করা যায়নি।” তৃণমূল নেতা বাবলু পালের পাল্টা বক্তব্য, “চাষিদের কম দাম দিয়ে জমি নেওয়া হয়েছিল।” তৃণমূল বিধায়ক বলেন, “আমরা চাই না, কেউ ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হোক। কিন্তু রাজ্য সরকারের যা আর্থিক অবস্থা তাতে চাষিদের অত বেশি হয়তো দেওয়া যাবে না। বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।”
বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধান, আলু, সব্জি, ফল এনে এই নিয়ন্ত্রিত বাজারে বসে সরাসরি বিক্রি করার কথা চাষিদের। গড়ে ওঠার কথা গুড় ও মুদিখানা দ্রব্যের বাজার। শ্যামলবাবু জানান, বাজার নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় আরআইডিএফ-১৫ প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি ২৪ লক্ষ এবং রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ২০১২-র মার্চের মধ্যে কাজ শুরু না হলে পুরো টাকাটাই ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও তাঁর আশ্বাস, “টাকা যাতে ফিরে না যায়, তার জন্য আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখব।” সমস্যার জট কবে, কী ভাবে খুলবে তা অবশ্য সকলেরই অজানা। |