|
|
|
|
সুরাহারও দিশা সমীক্ষায় |
বাড়িতেই বেশি প্রসব, সুন্দরবনে বিধ্বস্ত শিশু-স্বাস্থ্য |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
প্রতি তিনে এক জনের ফুসফুসে সংক্রমণ।
প্রতি পাঁচে তিন জনের ওজন স্বাভাবিকের অনেক কম।
পাঁচ বছরের কমবয়সীদের প্রায় ৬৫% গভীর অপুষ্টির শিকার।
নিউমোনিয়া-ডায়েরিয়ায় মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী।
সুন্দরবনের ১৯টি প্রশাসনিক ব্লকেই শিশু-স্বাস্থ্যের এই ‘ভয়াবহ’ ছবি ধরা পড়েছে ব্রিটিশ সংস্থা ‘ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট’ (সংক্ষেপে ডিএফআইডি)-এর সমীক্ষায়। গত পাঁচ বছর ধরে তারা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই সমীক্ষা চালিয়েছে। যাতে স্পষ্ট, আয়লা-পরবর্তীকালে সেখানকার পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে উঠেছে।
সমস্যা যে সত্যিই গভীর, তা মেনে নিচ্ছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও। স্বাস্থ্য-কর্তাদের ব্যাখ্যা: সুন্দরবনের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে একটা সময় পর্যন্ত তেমন ভাবনা-চিন্তাই হয়নি। এখন শুরু হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের কথায়, “ধাপে ধাপে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।”
বস্তুত প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হারই বলে দিচ্ছে, সুন্দরবনে শিশু-স্বাস্থ্যের গোড়ায় গলদ। গোটা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গড় যেখানে অন্তত ৭০%, সুন্দরবনে তা সাকুল্যে ২৯%। বাকিরা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেন না, তাঁদের ভরসা হাতুড়ে ও দাই। ফলে প্রসূতি ও সদ্যোজাত হামেশাই বিবিধ সংক্রমণের শিকার হয়। দিলীপবাবু বলেন, “বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে সুন্দরবনের জায়গায় জায়গায় কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট সেন্টার চালু হয়েছে। সেখানে নানা চিকিৎসার পাশাপাশি প্রসবের ব্যবস্থাও থাকে। কিন্তু এমন কেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় কম।”
সমীক্ষায় প্রকাশ, সুন্দরবনের শিশুদের অধিকাংশের ওজন বয়সের তুলনায় অত্যন্ত কম। পাঁচ বছর বয়সীদের অর্ধেকেরও বেশি নানান ক্রনিক অসুখে আক্রান্ত। তাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবের কারণ খুঁজতে গিয়ে শিশু চিকিৎসকেরা স্তন্যপানের অভাবের কথা বলছেন। তথ্য বলছে, জন্মের পরে প্রথম ঘণ্টায় মায়ের স্তন থেকে যে হলুদ তরল নিঃসৃত হয়, সুন্দরবনে অধিকাংশ শিশু সেই ‘কোলোস্ট্রাম’ খায় বটে, কিন্তু তার পরে ছ’মাস শুধু মায়ের দুধ খায় মাত্র ৩১%। কেন? দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ মা এমন গভীর অপুষ্টির শিকার যে, তাঁদের দুধের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। কিছু কিছু মা দূরে কাজ করতে চলে যান বলে বাচ্চাকে ঠিক সময়ে খাওয়ানোর সুযোগ পান না। সে ক্ষেত্রে ‘দুধের’ শিশুকে ভাতের ফ্যান খাওয়ানো হচ্ছে এমন নমুনাও সমীক্ষকদের চোখ এড়ায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের সর্বত্র বিধ্বস্ত এলাকায় সবচেয়ে পীড়িত হয় শিশুরা। সুন্দরবনও ব্যতিক্রম নয়। প্রত্যন্ত বহু অঞ্চলে সরকারি পরিষেবা ঠিক মতো পৌঁছয় না। উপরন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় সুন্দরবনবাসীর স্বাস্থ্যেও নানা ভাবে আঘাত হানছে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত সবচেয়ে বেশি শিশুরা। গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি ২, পাথরপ্রতিমা, নামখানা ও কুলতলি ছ’টি ব্লকে এই সমস্যা প্রবল বলে সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন।
‘ফিউচার হেল্থ সিস্টেমস রিসার্চ প্রোগ্রাম’ শীর্ষক ওই সমীক্ষার সমীক্ষকদলের প্রধান বরুণ কাঞ্জিলাল বলেন, “প্রতি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। কিন্তু সুন্দরবনে বহু জায়গাতেই থাকেন না। সন্দেশখালি১, গোসাবা আর হাড়োয়া এই তিনটে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো চলছে মাত্র দু’জন ডাক্তারের ভরসায়! মানুষের দূরে কোথাও চিকিৎসার জন্য যাওয়া খুব মুশকিল। হয়তো নদী পেরিয়ে, ভ্যানরিকশায় অনেকটা উজিয়ে তার পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অনেক গর্ভবতী স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেন না!” এর সুরাহা কী?
সমীক্ষকদের বক্তব্য: ব্লকে চিকিৎসা-পরিকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি গ্রামে চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকা জরুরি। বরুণবাবুর কথায়, “ওখানে ৭০ শতাংশেরও বেশি শিশুর চিকিৎসা মূলত হয় হাতুড়েদের কাছে। রাতারাতি এটা বদলানো যাবে না। তাই হাতুড়েদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে শিশুদের সাধারণ রোগের চিকিৎসার উপযুক্ত করে তোলা উচিত। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে কাজে লাগানো দরকার। আবার স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে প্যারাসিটামল, হ্যালোজেন ট্যাবলেট, ওআরএস, পেট খারাপের ওষুধ ইত্যাদি মজুত রাখা যেতে পারে।”
এবং ওঁদের পরামর্শ: সুন্দরবনের শিশু-স্বাস্থ্যর হাল ফেরাতে ৪৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সব ক’টির সংস্কার ও প্রতিটি ‘দুর্গম’ ব্লকে অন্তত একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রাখা জরুরি। পাশাপাশি প্রসূতি ও শিশুর স্বার্থে ছ’টি ‘দুর্গম’ ব্লকের ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সিজারিয়ান প্রসবের ব্যবস্থা রাখায় ওঁরা জোর দিচ্ছেন। চাইছেন চব্বিশ ঘণ্টা সরকারি যানবাহনের বন্দোবস্তও। |
|
|
|
|
|