তাঁর ’৮২-র ব্রাজিল দল সম্পর্কে বলা হত, অন্যতম সেরা দল, যারা বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। তাঁর সম্পর্কে বলা হত, বিশ্বের অন্যতম সেরা প্লে মেকার, কিন্তু নিজের প্রতিভার প্রতি সম্পূর্ণ সুবিচার করতে পারেননি। ৫৭ বছর বয়সে আজ সক্রেটিসের মৃত্যুর পর বোঝা গেল, জীবনের প্রতিও সুবিচার করতে পারেননি তিনি।
গতকাল সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে অন্ত্রে সংক্রমণের জন্য ভর্তি করা হয় সক্রেটিসকে। সংক্রমণ থেকে ‘সেপটিক শক’ হয়ে রবিবার স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মৃত্যু হয় ১৯৮২-র স্বপ্নের ব্রাজিল দলের অধিনায়কের। তিনি রেখে গিয়েছেন স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে।
এক দিকে দুর্দান্ত ফুটবলার। আবার ডাক্তার, শিল্পী, দার্শনিক। অন্য দিকে অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপানের শিকারসক্রেটিসের জীবন যেন বৈপরীত্যে ভরা ছিল। ক্লাব ফুটবলে সক্রেটিসকে দেখা গিয়েছে কোরিন্থিয়ান্সের হয়ে বেশি খেলতে। এ ছাড়াও তিনি খেলেছেন বোটাফোগো, ফিওরেন্তিনার হয়ে। শেষের দিকে ফ্ল্যামেঙ্গো এবং স্যান্টোসের হয়েও কিছু ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৮৯-তে ফুটবল বুট তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার। ফুটবলের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ না রেখে ডা. সক্রেটিস ব্রাজিল-রাজনীতি নিয়ে সরব হয়েছেন, ধারাভাষ্য দিয়েছেন, নিয়মিত সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন। জীবনটাকে কখনও থেমে থাকতে দেননি। এমনকী মৃত্যুর এক দিন আগেও সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমার কাছে জীবন হল সবথেকে মূল্যবান জিনিস। আমি শুধু শুধু সেটা ছুড়ে ফেলে দেব কেন?”
সক্রেটিসের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন ফুটবলবিশ্ব আর তার রেশ এসে পড়েছে এ দেশেও। চুনী গোস্বামী থেকে হোসে ব্যারেটো সবার মধ্যে আবেগ, কখনও আক্ষেপ।
চুনী গোস্বামী: বিরাশি ও ছিয়াশি বিশ্বকাপে আমি সক্রেটিসের খেলা দেখেছি। এক কথায় স্টাইলিশ ফুটবলার, ভীষণ পরিচ্ছন্ন খেলত। মিডফিল্ডে জিকোর সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। তবে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরাদের মধ্যে সক্রেটিস থাকবে পরের সারিতে। প্রথম সারিতে পেলে, গ্যারিঞ্চা, রোনাল্ডিনহো।
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: এক জন ডাক্তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিশ্ব ফুটবল শাসন করছে, এমন উদাহরণ ক’টা আছে জানি না। এ দিক দিয়ে সক্রেটিস অনন্য। দুটো বিশ্বকাপে ওকে দেখেছি। একটা উদাসীন ব্যক্তিত্ব ছিল, ছিল ‘ডোন্ট কেয়ার’ মার্কা হাবভাব। ডাক্তারি পাশ করে খেলতে এসেছিল বলে কি না বলতে পারব না, কিন্তু মিডফিল্ড থেকে গোটা মাঠটাকে ক্লিনিক্যালি ভাগ করতে পারত। পাশে খেলত জিকোর মতো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, যে অধিকাংশ সময়ে প্রচারের আলো বেশি পেত। সক্রেটিসের তাতে কিছু এসে-যেত না। পুরো মাঠটা একা নিয়ন্ত্রণ করত। কোনও দিন কোনও বাদানুবাদে জড়িয়েছে বা মাথা গরম করেছে বলে কেউ শোনেনি। ফুটবলের নীরব, একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবেই ওকে মনে রাখব। এক কথায় মাঠের বাইরের অসংযমী জীবন বাদ দিলে সক্রেটিস হল ফুটবলের রাহুল দ্রাবিড়। অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করতে পারছি না। |
হোসে ব্যারেটো: আমি সক্রেটিসকে কখনও দেখিনি, যখন উনি বিরাশির বিশ্বকাপ খেলেছেন, আমার বয়স তখন বড়জোর ছয় কি সাত। ব্রাজিলের প্রথম পাঁচ কিংবদন্তির মধ্যে ওকে রাখব না। কারণ যে দুটো বিশ্বকাপে খেলেছেন, তার একটাও জেতেনি ব্রাজিল। প্রথম পাঁচে রাখতে না পারলেও ওঁকে শ্রদ্ধা করি। খুব বুদ্ধিমান মিডফিল্ডার ছিলেন। আমার দাদু ছিলেন সক্রেটিসের কোরিন্থিয়ান্স ক্লাবের সমর্থক।
গৌতম সরকার: সক্রেটিস আমাদের সমসাময়িক। ওই রকম রোগা, আমাদের চেয়ে সামান্য লম্বা চেহারা। কী করে গোটা মাঠ জুড়ে খেলত, ছিয়াশি বিশ্বকাপে মাঠে বসে অবাক হয়ে দেখেছিলাম। আমি নিজে মিডফিল্ডার ছিলাম বলে ওর খেলাটা আরও বেশি লক্ষ্য করতাম। দুর্দান্ত ফাইনাল পাস যখন-তখন পা থেকে বেরোত। অফ দ্য বল এত গতি আর কোনও মিডফিল্ডারের মধ্যে দেখিনি। ধূমপান করত ফুটবলজীবনেই।
প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়: বিরাশির বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মিডফিল্ড ছিল স্বপ্নের মিডফিল্ড। জিকো, সক্রেটিস, ফালকাও। পাওলো রোসি-র কাছে ব্রাজিলকে হারতে হলেও যে ফুটবলটা সক্রেটিসরা, খেলেছিলেন, এখনও চোখে লেগে রয়েছে। পাসিং হোক বা শুটিং, গোটা মাঠে জাদুকরের মতো ছড়ি ঘোরাতেন সক্রেটিস।
|
• ২০ বছর বয়সে ফুটবলজীবন শুরু বোটাফোগোয়। ৫৭ ম্যাচে ২৪ গোল।
• চার বছর পর করিন্থিয়ান্সে যোগ দেন। খেলেন টানা ছ’বছর ২৯৭ ম্যাচ খেলে
গোল করেন ১৭২টি। ইউরোপে খেলেছেন শুধু ইতালির ফিওরেন্তিনায়।
• ’৭৯-তে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে ’৮২ বিশ্বকাপে অধিনায়ক। জিকো, ফালকাও,
জুনিয়রদের নিয়ে অন্যতম সেরা ব্রাজিলীয় দল হওয়া সত্ত্বেও ইতালির কাছে হেরে বিদায়।
• ’৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে সক্রেটিসের দুর্বল শট
আটকে দেন ফরাসি গোলকিপার জোয়েল বাটস। ব্রাজিল ৩-৪ হেরে যায়।
• মারা যাওয়ার আগে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের উপর কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে বই লিখছিলেন। |
|