শুশুক নিয়ে নাটক শেখাতে নেপালের পরিচালক সলিল কণিকা এসেছিলেন অসমে। কিন্তু, বাস্তবে ঘটল উল্টো। অসমের সংরক্ষণকারী ও সাধারণ গ্রামবাসীদের কাছ থেকেই শুশুক বাঁচানোর পাঠ নিয়ে ঘরে ফিরছেন সলিল কনিকা। অসমের ধাঁচেই এ বার নেপালে শুশুকরক্ষায় আন্দোলন গড়ে তুলবেন তিনি।
অক্টোবরের শেষ দিকে ডলফিন ঠাসা কুলসি নদীর তীরে স্কুলের ছাত্রছাত্রী স্থানীয় গ্রামের কৃষকও মৎসজীবীদের নিয়ে বসেছিল প্রথম শুশুক সংরক্ষণ কর্মশালা। লন্ডনের জ্যুলজিক্যাল সোসাইটি থেকে আসা পরিবেশবিদ রাজ আমিন ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের সব থেকে পছন্দের প্রাণী কী?’ কেউ বলল বাঘ, কেউ সিংহ, কেউ বা হাতি। শুনে রাজ বললেন, “এটাই সমস্যা।
বড় বড় প্রাণীদের নিয়েই যত মাতামাতি। কিন্তু প্রচারের আলো না পেয়ে আমাজন, ইয়াং সি, সিন্ধু, ইরাবতী আর গাঙ্গেয় শুশুকের মধ্যে চিনে ইয়াং সি অববাহিকায় শুশুক বিলুপ্ত। শীঘ্রই হয় তো হারিয়ে যাবে গঙ্গার শুশুকও।”
শুশুক বাঁচাতে, অসমের একটি পশুপ্রেমী সংস্থা সংরক্ষণ কর্মসূচি ও সমীক্ষা চালাচ্ছে। সেই উদ্যোগের শরিক হতেই নেপাল থেকে এসেছিলেন সংরক্ষণ নাট্যকর্মী সলিল। এখন ব্রহ্মপুত্রে শুশুক তিনশোরও কম। অথচ১৯৯৭ সালেও সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৪০০। শুশুকসমৃদ্ধ ব্রহ্মপুত্রের এক উপনদী কুলসি। গুয়াহাটি থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে কুলসি আর কুইয়ার জলধারা যে অংশে মিলছে, সেখানে কিন্তু বিপন্ন তালিকাভুক্ত শুশুকের আড়ত। ডলফিন বিশেষজ্ঞ আবদুল ওয়াকিদ জানান, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া চিত্র, জিআইএস ব্যবহার করে শুশুক বসতি চিহ্নিত করার পরে, অ্যাকুস্টিক হাইড্রোফোন যন্ত্র দিয়ে চালানো হচ্ছে টানা সমীক্ষা। মূল গণনা অবশ্য চোখে দেখা নির্ভর।
আর এক শুশুক গবেষক সানি দেউড়ি জানান, শুশুক অন্ধ। তার মূল ভরসা তরঙ্গ। প্রতিটি শুশুকের তরঙ্গ ভিন্ন। হাইড্রোফোন সেই তরঙ্গ বিচার করে এদের সংখ্যা নির্ধারণ করে। কলকাতার ছেলে চন্দন রি এখন অসমে শুশুক গবেষক। তিনি জানান, ব্রহ্মপুত্রের উপনদীগুলির মধ্যে কুলসির ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘে অন্তত ২৯টি শুশুক রয়েছে। তার বেশির ভাগই কুকুরমারা এলাকায়। ‘আরণ্যক’-এর জয়ন্ত পাঠক জানান, ছোট্ট এই জনপদ যে ভাবে কয়েক দশক ধরে শুশুক সংরক্ষণের ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছে, তা কোনও প্রচার পায় নি। শুশুক মারা এখানে পাপ বলে গণ্য করা হয়। এমনকী, শুশুকের ক্ষতি হবে ভেবে গিল জাল ব্যবহার করা হয় না এখানে। জমিতে ব্যবহৃত হয় না বিষাক্ত কীটনাশকও। লন্ডন জ্যুলজিক্যাল সোসাইটির বিশেষজ্ঞও স্থানীয় মানুষের শুশুকপ্রেম দেখে মুগ্ধ।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ বিভাব তালুকদার বলেন, “ব্রহ্মপুত্রের পুরো ধারা বরাবর সর্বত্র শুশুক বাঁচাতে প্রচার চালানোর কথা ভাবছিলাম আমরা। স্থানীয় মানুষকে নিয়ে স্থানীয় ভাষায় নাটক করে বিষয়টি তুলে ধরলে, তা বেশি হৃদয়গ্রাহী হয়। তাই সংরক্ষণবাদী নাট্যকার সলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।”
কুকুরমারার বাসিন্দা, অসমের নানা ডলফিন সমীক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুশুক সংরক্ষণের উপরে নাটক করার প্রক্রিয়া মধ্য অক্টোবরে শুরু করেন সলিল। তাঁর কথায়, “আমিও প্রথমবার জলজ প্রাণী নিয়ে নাটক করলাম। অসম আসাও প্রথমবার। শেখানোর জন্য এসে নিজেই বরং অনেক কিছু শিখলাম।” অসমের ব্রহ্মপুত্র ও নেপালের কর্ণালী নদীর উৎস রাক্ষসতাল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রে শুশুক বাঁচাতে যে ভাবে কাজ ও সমীক্ষা হচ্ছে, তা নেপালে হচ্ছে না। সলিল বলেন, “কর্ণালীতে এখন মাত্র ৯ থেকে ১০টি ডলফিন বেঁচে রয়েছে। তাই, অসম মডেল নিয়ে আমি ঘরে ফিরছি। এ বার নেপালেও শুশুক সংরক্ষণে আন্দোলন করতে হবে।” |