সিন্ডিকেট-ব্যবসা বা প্রোমোটারির সঙ্গে যুক্ত না-থাকার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের এ বার প্রকাশ্যেই ‘বার্তা’ দিলেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের অভ্যন্তরে তিনি ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে ‘কড়া’ অবস্থান নিয়েছেন। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার অব্যবহিত পরে রবিবার মমতা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, “কোথাও কোথাও আমাদের দলের কেউ কেউ সিন্ডিকেট, প্রোমোটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। ওই সিন্ডিকেট, প্রোমোটিং আমি ভেঙে দিতে চাই।”
রাজারহাট, কেষ্টপুর এলাকায় তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা খুন হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে ইট-চুন-বালি সরবরাহের সিন্ডিকেট করা নিয়ে ‘অনৈতিক’ কাজের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। দলের অন্দরে এই নিয়ে বিবাদ প্রকাশ্যে চলে আসায় তৃণমূল নেতৃত্ব কিঞ্চিৎ ‘বিব্রত’-ও। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও দলের যাঁরা প্রোমোটারি বা সিন্ডিকেট-ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকছেন, তাঁদের যে তিনি ‘ছেড়ে কথা’ বলবেন না, তা এ দিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তিনি প্রায়ই বলেন, কর্মীরা দলের ‘সম্পদ’। তাদের কেউ দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে তিনি ‘অবাধ্যদের’ শাস্তি দেবেন বলে এ দিন ‘বার্তা’ দিয়েছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, তৃণমূলের ‘৯৯.৯৯%’ কর্মীই ভাল। যে সামান্য অংশ সমস্যা তৈরি করছে, তাদের বরদাস্ত করা হবে না।
তৃণমূল নেত্রীর কথায়, “মা যেমন সন্তানকে ভালবাসেন, তেমনই শাসনও করেন। চড়ও মারেন।” গত বৃহস্পতিবার মহাকরণে রাজারহাটের ব্যাপারে স্থানীয় বিধায়ক ও রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মুকুল রায়কে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। মমতা সে দিনই নির্দেশ দিয়েছিলেন, দলের কোনও ‘পরিচিত মুখ’ রাজারহাট এলাকায় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। দলের ভিতরে মমতা জানিয়েছেন, কেউ ‘ব্যক্তিগত’ ভাবে ব্যবসা করতেই পারেন। কিন্তু দলে থেকে তা করা চলবে না। পাশাপাশিই, সিপিএম থেকে তৃণমূলে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ সঙ্গে তাঁর দলে-থাকা অন্য ‘বামপন্থীদের’ আলাদা করে দেখিয়ে মমতা এ দিন প্রকাশ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, পূর্ণেন্দুবাবুর প্রতি তাঁর ‘আস্থা’ আছে।
মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি ‘স্বচ্ছ’ রাখতে তিনি ‘কড়া’ পদক্ষেপ করতে যে কসুর করবেন না, তা-ও এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। ‘পরিবর্তনের’ পরে অন্য দল থেকে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে। দলের একাংশের মতে, কোথাও কোথাও অন্য দল থেকে আসা এই ‘নব্য তৃণমূলের’ সঙ্গে ‘আদি তৃণমূলের’ সংঘাত তাদের সংগঠনের ‘ভাবমূর্তিকে’ খারাপ করছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই মমতা এ দিন বলেন, “অন্য কোনও দল থেকে আমার দলে অনুপ্রবেশ করে কেউ যদি দলের বা আমার সরকারের বদনাম করার চেষ্টা করে, তাদের আমি ছেড়ে দেব না!” মমতার এই হুঁশিয়ারির পরে অন্য দল থেকে লোক নেওয়ার সময় তৃণমূল কোনও ছাঁকনি প্রয়োগ করে কি না, তা-ই এখন দেখার।
রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনের পরে বিভিন্ন এলাকায় সিপিএমের কিছু লোক তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের একাংশের অভিযোগ, সিপিএম ছেড়ে-আসা লোকজনই মূলত গোলমাল করছে। কেষ্টপুর এলাকায় দলীয় নেতা স্বপন মণ্ডলের খুন হওয়া এবং দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার প্রেক্ষিতেই মন্ত্রী পূর্ণেন্দুবাবুর মতো নেতাদের নিয়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু পূর্ণেন্দুবাবুর মতো ‘বামপন্থীরা’ যে সিপিএমের থেকে ‘আলাদা’, তা বুঝিয়ে দিয়ে মমতা বলেছেন, “অনেক বামপন্থী আমাদের দলে আছেন। কিন্তু সিপিএমের কিছু লোক আমাদের দলে এসে আমার দলের বদনাম করাবে, এটা আমি সহ্য করব না!”
কেষ্টপুর-কাণ্ডে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব, বিশেষত পূর্ণেন্দুবাবু ও তাঁর সহকর্মী দোলা সেনকে নিয়ে ‘বিতর্ক’ প্রকাশ্যে আসুক এটা যে দলনেত্রী হিসাবে মমতা চাইছেন না, তা এ দিন তাঁর বক্তব্যেই বোঝা গিয়েছে। একই ভাবে দলীয় ‘শৃঙ্খলা রক্ষার’ প্রশ্নে তিনি যে কোনও আপসের পথে হাঁটবেন না, তারও ইঙ্গিত তিনি দলের সর্ব স্তরেই দিয়েছেন। আর মমতা তা করেছেন দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী সুব্রত বক্সী বিপুল ভোটে জয়ী বলে ঘোষিত হওয়ার পরেই। তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, “রাজ্যে ৪০০ ব্লকের মধ্যে এক, দুই বা তিন জায়গায় গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশাসন বা দলকে হেয় করা উচিত হচ্ছে না। কেউ গোষ্ঠীবাজি করলে বা বিশ্বাসঘাতকতা করলে তা বরদাস্ত করা হবে না!” দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “দল পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের নেত্রী কোনও অন্যায়কে যে প্রশ্রয় দেবেন না, তা উপযুক্ত সময়েই জানিয়েছেন।” |