বিজ্ঞান ও প্রজুক্তি মূক-বধিরদের শিক্ষায় ইঙ্গিতের
ভাষা এ বার সফ্টওয়্যারে

রাজ্যের মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের কয়েকটি স্কুলে চালু হয়েছে অভিনব এক শিক্ষাপদ্ধতি। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইঙ্গিতের ভাষামূক ও বধিরদের মনের ভাব প্রকাশে যা একমাত্র সম্বলতার সঙ্গে কম্পিউটার বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে এক সফ্টওয়্যার। যার সাহায্য পেয়ে লাভবান হচ্ছে আগ্রহী স্কুলগুলি।
কী ভাবে? উত্তর ২৪ পরগনায় রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুল, জলপাইগুড়িতে সেন্টার ফর স্পেশ্যাল এডুকেশন ফর দ্য ডিজএবল্ড চিলড্রেন কিংবা এ রকম আরও পঁয়তাল্লিশটি জায়গায় মূক ও বধির ছাত্রছাত্রীরা ইঙ্গিতের ভাষা শিখছে কম্পিউটারে ফুটে ওঠা ছবি দেখে। ওদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি সফ্টওয়্যার অক্ষরমালার বক্তব্যকে মুহূর্তে বানিয়ে ফেলছে ছবি। ইঙ্গিত করে দেখানোর ছবি। কোন কথা বোঝাতে কী ইঙ্গিত, তা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে তিলে তিলে শেখার বদলে সফ্টওয়্যার যেন এক আশীর্বাদ। কম্পিউটার নিজেই বনেছে লিখিত শব্দের মহাভাণ্ডার। তার কি-বোর্ডে শুধু টাইপ করতে হবে শব্দ কিংবা বাক্য। সঙ্গে সঙ্গে তা রূপান্তরিত হয়ে যাবে ইঙ্গিতের ভাষায়। মনিটরে ফুটে উঠবে ছবি হয়ে।
মূক ও বধির ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে কম্পিউটার-বিজ্ঞান এগিয়ে আসায় রীতিমতো খুশি জলপাইগুড়ির স্বাতী মিত্র মজুমদার। বললেন, ‘প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা ইঙ্গিতের ভাষা সহজে এবং তাড়াতাড়ি শিখতে পারছে এই সফ্টওয়্যারের সাহায্যে। আমরা যারা ওদের শেখাই ইঙ্গিতের ভাষা, তাদেরও কাজে লাগছে জিনিসটা।’ একই বক্তব্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুল-এর শিক্ষক বিশ্বজিৎ ধরের। বললেন, ‘আজকালকার বাচ্চারা কম্পিউটার পছন্দ করে। মূক ও বধির বাচ্চারাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। ওরা যখন দেখছে ওই যন্ত্রটা সাহায্য করতে পারে ওদের ভাষা শেখার কাজেও, তখন পড়াশোনায় উৎসাহ বাড়ছে।’
নতুন এই সফ্টওয়্যার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের প্রায় দু’বছরের পরিশ্রমের ফসল। ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার (ভিইসিসি) এবং ওয়েবল মিডিয়াট্রনিক্স সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ওটি। ওয়েবল না হয় তথ্যপ্রযুক্তির কাজে যুক্ত প্রতিষ্ঠান, কিন্তু ভিইসিসি? তার কাজ তো পরমাণু গবেষণা। ‘হ্যাঁ, মূল কাজ সেটাই’, বললেন ভিইসিসি-র কম্পিউটর অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স গ্রুপ-এর প্রধান দেবরঞ্জন সরকার, ‘সাধারণ মানুষ মনে করে, পরমাণু শক্তি দফতরের একমাত্র কাজ বুঝি ওই গবেষণা। তা কিন্তু নয়। আমাদের দফতরের তরফে যথেষ্ট উৎসাহ দেওয়া হয় ভারতবাসীর জীবনের মানোন্নয়নমূলক গবেষণায়। একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নতুন কাজের তালিকা রচনার সময় আমরা ভাবলাম, এমন কিছু করব যাতে প্রতিবন্ধী শিশুদের উপকার হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই তৈরি হয়েছে নতুন সফ্টওয়্যার।’ ওয়েবল-এর শশাঙ্ক দত্ত বললেন, ‘সেরিব্রাল পালসি-আক্রান্ত শিশু, দৃষ্টিহীন, মূক-বধির কিংবা আরও নানা প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের সাহায্যে মাল্টিমিডিয়া উপকরণ আমরা বহু দিন বানিয়ে চলেছি। নতুন সফ্টওয়্যার ওই ধারায় একটা বিশেষ পদক্ষেপ।’
শুধু সফ্টওয়্যার বানানো নয়, তার বহুল প্রচার যে ভীষণ জরুরি, তা বোঝাতে একখানি তথ্যচিত্রও বানিয়েছেন ভিইসিসি এবং ওয়েবল কর্তৃপক্ষ। তাতে দেখানো হয়েছে মূক ও বধির নরনারীর জগৎ। যার ছবিটা প্রায় দৃষ্টিহীনদের দুনিয়ার মতোই করুণ। দৃষ্টিহীন কিছু দেখতে না পেলেও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে মুখের ভাষায়। মূক-বধির মানুষ সব দেখেও পাশের কাউকে বোঝাতে পারে না নিজের ভাবনা। তথ্যচিত্রটিতে একাধিক নারী-পুরুষ বর্ণনা করেছেন তাঁদের স্কুলজীবনের যন্ত্রণার দিনগুলি। কী ভাবে তাঁরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে ক্লাসে হয়ে পড়তেন ব্রাত্য। শিক্ষক-শিক্ষিকার শুধু ঠোঁট নড়া দেখে কি পাঠ্য বিষয় বোঝা যায়?
শব্দ কিংবা বাক্যকে ইঙ্গিতের ভাষায় রূপান্তরের সফ্টওয়্যার বানাতে ভিইসিসি এবং ওয়েবল সাহায্য নিয়েছিলেন এক মহিলার। তিনি শুভা সরকার। মূক-বধির মা-বাবার সন্তান শুভা। তাঁর ভাই কথা বলতে পারেন না। পরিবারে কেবল তিনিই সবাক। ভিইসিসি এবং ওয়েবল-এর কর্মীদের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর খেটেছেন তিনি। শব্দ বা বাক্যকে ইঙ্গিতে বোঝাতে। তাঁরই ছবি ফুটে ওঠে মনিটরে। ‘আমি এমন একটা পরিবারে জন্মেছি, যেখানে অন্যের মুখের ভাষা শোনার সুযোগ ছিল না’, বললেন শুভা, ‘বলতে পারেন, আমার বড় হওয়া এক চরম নৈঃশব্দের মধ্যে। আমি নিজে কথা বলতে পারলে কী হবে, বাড়ির আর সকলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম তো ছিল কেবল ওই ইঙ্গিতের ভাষা। ওটা তাই আমার সহজাত দক্ষতা বলতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি বলে আমি ধন্য মনে করছি।’
সফ্টওয়্যার তৈরি করতে গিয়ে সমস্যার কথা বোঝালেন ভিইসিসি-র কর্মী বিশ্বজিৎ সরকার। বললেন, ‘সবাক এবং নির্বাক মানুষের ভাষায় বাক্যগঠন এক নিয়মে এগোয় না। আমরা বলি, সে ভাল ছেলে। বিশেষণ শব্দটি মাঝখানে। মূক-বধির মানুষেরা বলেন, সে ছেলে ভাল। বিশেষণ চলে গেল শেষে। বাক্যে শব্দের জায়গা বদলের জন্য সফ্টওয়্যার তৈরিতে সাবধানে এগোতে হয়েছে। এ ছাড়াও আছে একই জিনিস বোঝাতে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ইঙ্গিতের ব্যবহার। সেটাও সমস্যার সৃষ্টি করেছে।’
অবশ্য বাধা-বিপত্তিতে পিছিয়ে পড়তে চান না ভিইসিসি-র দেবরঞ্জন কিংবা ওয়েবল-এর শশাঙ্ক। বাংলার পর এ বার ওঁরা নেমে পড়েছেন হিন্দি ভাষার জন্য সফ্টওয়্যার বানানোর কাজে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.