প্রতিবন্ধীদের সাহায্যে প্রাক্তন শিক্ষকের উদ্যোগ
চাকরি ছেড়ে ‘স্বপ্ন-তোরণ’
ঘিঞ্জি ঘর, জানালার ভগ্নপ্রায় কাঠের পাল্লার নীচে রাখা টেবিল থেকে একটি মোটা বাঁধানো খাতা মেলে ধরলেন তিনি। একমুখ দাড়ি, অবিন্যস্ত জামা কাপড়, রঙ ওঠা সোয়েটার গায়ে দেবাশিষ চক্রবর্তী জানালেন, খাতাটি তার মূল প্রেরণা। খাতাটি না থাকলে ৩০ জন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে জড়ো করতে পারতেন না। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের নানা কাজের সুবাদে পাওয়া প্রশংসার কথা রয়েছে ওই কথায়। তাদের সকলের নামে ব্যাঙ্ক আকাউন্টও খুলে দিতে পারতেন না। সেই অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে টাকাও জমা পড়ত না। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ সব সময়ে তাদের চোখে চোখে রাখতে হয়। তাই বছর দুয়েক আগে শিক্ষকতার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন। সকাল থেকে গমগম করে জলপাইগুড়ির সেনপাড়ার দেবাশিস বাবুর বাড়ি। বাড়ি বলতে পাশাপাশি দুটি ঘিঞ্জি ঘর। সেখানে বসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েরা হাতের কাজের জিনিস তৈরি করে। সেগুলি বিক্রি হয় জেলার বিভিন্ন মেলায়। সেখান থেকেই যা আয় হয় তা জমা পড়ে সকলের ব্যাঙ্ক আকাউন্টে। বর্ষার তিন মাস কোনও মেলা হয় না, সে সময় বিদ্যুতের মিস্ত্রির কাজ করেন বিএড পাশ করা দেবাশিসবাবু। সেখান থেকেই টাকা জমিয়ে রাখে ‘স্বপ্ন তোরণের’ নামে থাকা আকাউন্টে। কী ভাবে জন্ম স্বপ্ন তোরণের? দেবাশিস বাবু জানালেন, তখন ২০০৭ সাল। তিনি একটা স্কুলে পড়ান। একদিন রাতে সদর হাসপাতালের সামনে দেখেন, এক মূক ও বধির কিশোরকে কে কারা যেন মদ খাইয়ে দিয়েছে। নেশায় টালমাটাল অবস্থায় কিশোরটি উঠছে। পড়ে যাচ্ছে। আর চাপা একটা গোঙানি তার মুখ থেকে যন্ত্রণার মতো বার হচ্ছে। অনেকেই তাকে দেখে হাসছে, টিটকিরি দিচ্ছে। দেবাশিসবাবু বলেন, “দৃশ্যটা আজও চোখে ভাসে। তখনই ঠিক করি ওদের জন্য কিছু করতে হবে। ওদেরই ঘুরে দাঁড় করানো শেখাতে হবে।” সে দিনের সেই ‘ভবঘুরে, মদ্যপ’ কিশোরটি, রাজু মাহাতো। এখন সে তুলির এক টানে এঁকে দেয় রবীন্দ্রনাথের ছবি। এখন প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে হাতে পায় রাজু। এমন ভাবেই স্বপ্নতোরণের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৩০ জন। দেবাশিসবাবু বললেন, “পম্পি খুব ভালো বেতের কাজ করে, আর ওই যে দূরে বসে রয়েছে রিঙ্কি ও খুব লাজুক, বাঁশ কেটে ফুলদানি তৈরিতে ওর জুড়ি নেই। ওই যে মহাদেব সুন্দর রঙ করে।” ঘর ভর্তি ছেলে মেয়েরা গোল করে দাঁড়িয়েছে ওঁর পাশে। সকলেই দুস্থ পরিবারের। বস্তি, নদীর চড়ে ওঁদের বাড়ি। বেশির ভাগই মূক ও বধির। দেবাশিস বাবু নিজে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওদের সকলকে ইশারায় মনের ভাব বোঝানোর কৌশল শিখিয়েছেন। কোনও সরকারি সাহায্য পান? দেবাশিসবাবু বললেন, “একবার জেলা শিল্প কেন্দ্র ওদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেয়। এর বেশি কিছু পাইনি। একটা স্কুল করার জন্য প্রশাসনের কাছে জমি চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। উত্তর পাইনি। তবে একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।” চার বছর ধরে ওরা ৯০ হাজার টাকা জমিয়েছিল, তার সঙ্গে শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য মিলিয়ে চলতি বছরে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা দিয়ে তিন কাঠা জমি কিনেছে স্বপ্নতোরণ। ইচ্ছে একটা স্কুল আর হস্টেল তৈরির। জলপাইগুড়ির বিধায়ক সেই জমিতে বাড়ি তৈরি করার জন্য টাকা মঞ্জুর করেছেন। আপাতত সেই টাকার জন্য জেলাশাসকের দফতরে নিয়মিত যান দেবাশিসবাবু। তিনি বললেন, “পেনশনের টাকায় মায়ের চলে যায়। আমার পরিবার বলতে ওরাই। তবে আমাদের সঙ্গে কোনও প্রভাবশালী লোক নেই। তবু ওদের দিকে চেয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি একদিন স্বপ্ন পূরণ হবে আমাদের।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.