প্রবন্ধ ২...
শুধু পিছিয়ে পড়ার আক্ষেপ?
দুশ্চিন্তাগুলি যথাযথ। পাহাড়ের একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার; জঙ্গলমহলে শান্তি জরুরি; প্রেসিডেন্সি’কে তার ‘হৃত গৌরব’ ফেরত দিতেই হবে। এ সমস্যাগুলিকে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু করে তোলার সরকারি সাফল্যের মাঝেই আমাদের সামনে হাজির হল মূর্তিমান এক উদ্বেগ এক ভয়াবহ তথ্য: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি শিশুদের শতকরা ৮৮ ভাগেরই পুষ্টির অবস্থা কাম্য মাত্রার নীচে।
এমন অপুষ্টি নিয়ে আর যা-ই হোক, দেশ গঠন চলে না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এটা নিয়ে প্রত্যাশিত বিচলন ও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, এবং সেখানেই প্রশ্নটার একটা উত্তর লুকিয়ে আছে। যার অভাবে পুষ্টির এই ঘাটতি, তার একটা বড় দিক হল, যাদের মধ্যে এই অপুষ্টি তাদের সঙ্গে, যাঁরা অপুষ্টি দূর করতে ভূমিকা নিতে পারেন, তাঁদের সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতাগত দূরত্ব। শুধু পুষ্টি নয়, শিক্ষার ব্যাপারেও এটা সত্য এবং কার্যত দুটো জিনিসের যোগও খুব জোরালো। বিষয়টা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্যটি এসেছে রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের করা একটি সমীক্ষা থেকে। (‘এক তীব্র কিন্তু নীরব দুর্ভিক্ষ...’, স্বাতী ভট্টাচার্য, ২৯-১১) ‘দীপঙ্কর’ নাম দেওয়া এই প্রকল্পের পাইলট হিসেবে কাজ শুরু হয় হাওড়া, কলকাতা ও দুই চব্বিশ পরগনা জেলায়। এই জেলাগুলির সরকার পরিচালিত সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি শিশুদের পুষ্টি (ওজন ও উচ্চতা), সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব, মা-বাবার শিক্ষার স্তর, শিশুদের প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি তথ্য তুলে আনা হয়েছে সমীক্ষায়। সংগৃহীত তথ্যের মধ্যে এ পর্যন্ত ৮২ শতাংশের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যে প্রাথমিক চিত্র বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে পুষ্টির দিকটা আগেই উল্লিখিত। এখানে আরও কয়েকটি দিক তুলে ধরব, যেগুলি অপুষ্টির সঙ্গে শিক্ষার সামাজিক বিভাজনের সম্পর্কটি বুঝতে হয়তো সাহায্য করবে।
আনন্দ-পাঠ? সব শিশু কেন এই সুযোগটুকু পাবে না?
প্রথমত, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি শিশুদের সামাজিক পরিচিতিগত বিভাজন থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৬৯ শতাংশ) মুসলমান ও দলিত। স্কুলে ভর্তির এই সামাজিক বিন্যাসটি কিন্তু জেলাগুলির মোট জনবিন্যাসের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীগুলির জনসংখ্যায় শিশুদের ভাগ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় কিছু বেশি হয়, এটা ধরে নিলেও কিন্তু শিশুভর্তির যে প্যাটার্নটা আমরা পাচ্ছি, তাতে সরকারি স্কুলগুলিতেও দুর্বলতর ও সুযোগবঞ্চিত বাড়িগুলি থেকে আসা শিশুদের কেন্দ্রীভবনটা স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, শিশুদের আর্থিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এদের মধ্যে ৩৮ শতাংশই এসেছে বিপিএল বাড়ি থেকে (৩৯ শতাংশ এপিএল এবং ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে চিহ্নিতকরণ করা যায়নি)। অর্থাৎ, এই স্কুলগুলিতে ঘোষিত দারিদ্রের অংশটিও বেশ বড় (অঘোষিতদের নিয়ে বিতর্ক বাদ দিলেও)।
তৃতীয়ত, শিশুদের মা-বাবার শিক্ষাগত স্তর থেকেও উপরের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হয়: ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে বাবা ও ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে মা নিরক্ষর; যথাক্রমে ৪৭ ও ৪৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বাবা ও মা-র শিক্ষার স্তর কেবল প্রাথমিক স্তর পর্যন্তই। আনুপাতিক দিক দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির আধিক্য ও ‘অন্যান্য’দের এই স্কুলগুলিতে আনুপাতিক স্বল্পতার বড় পরিণাম আছে। এটা এই যে, যাঁরা তুলনামূলক ভাবে ক্ষমতাবান ও ব্যবস্থা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারেন, সরকারি স্কুলগুলির সঙ্গে তাঁদের প্রত্যক্ষ স্বার্থের যোগটা ক্ষীণ, কেননা, এঁদের একটা বড় অংশ প্রাইভেট স্কুলকেই ‘উন্নততর বিকল্প’ হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। (আবার, এঁদের অনুকরণে শাসিতদের একটা অংশও সে পথে হাঁটার চেষ্টা করছেন, যদিও অপবিকশিত প্রাইভেট ব্যবস্থায় তাঁরা পেট কেটে নিজের সন্তানদের যেখানে ভর্তি করেন, সেগুলির বেশির ভাগেরই মান সরকারি স্কুলের মানের চেয়ে অনেক খারাপ।) শিক্ষার বহুস্তরীভবনে সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার অংশটির কাছে একমাত্র বিকল্প সরকারি স্কুলগুলি।
শিশুদের হাল: দীপঙ্কর প্রকল্পের তথ্য
৩৮% শিশু বিপিএল বাড়ির।
১৪%-র বাড়ি ও স্কুলের দূরত্ব ১ কিলোমিটারের বেশি।
১৭% বাবা ও ২৩% মা নিরক্ষর; ৪৭% বাবা ও ৪৬% মা-র শিক্ষা প্রাথমিক পর্যন্ত।
৩১%-র কথা বলার, ১১% দৃষ্টির, ১২% শোনার ও ২৭% চলাফেরার সমস্যা।
এক সময় শাসিতদের শিক্ষালাভের কোনও সুযোগই ছিল না। জনশিক্ষা প্রসারে ব্যর্থতার যাবতীয় দায় টি বি মেকলে-র ১৮৩৫ সালের মিনিট-এর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাটি এখনও বহমান। কিন্তু মেকলে একা তো নন; তাঁর এ দেশীয় অঘোষিত ভক্তরাও তো এক সময় শূদ্রদের শিক্ষা না-পাওটাকে একেবারেই স্বাভাবিক বলে ঘোষণা করেছিলেন (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১ ভাদ্র ১৭৬৫ শক, ১ সংখ্যা)। যে সুরে ও স্বরে শূদ্রদের প্রতি অবজ্ঞা ও মুসলমানদের প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছিল, আজকের দিনে সেটা সম্ভব নয় (যতই কেন না তার চোরা স্রোত শক্তিশালী থাক)। আমাদের গণতন্ত্রের অনেক খামতি সত্ত্বেও তাতে দুর্বলতমদের কিছু কিছু রক্ষাকবচ আছে। সেই কবচ তাঁরা নানা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন, কেউ দয়া করে দেয়নি, তার জোরে তাঁরা কখনও কখনও তাঁদের কণ্ঠস্বর তুলেও ধরতে পারেন। এটা না হলে আজ সরকারি স্কুলগুলি থাকতই না; নিচু তলার লোকেরা শিক্ষার যে সুযোগটুকু পাচ্ছেন, কিছুটা সক্ষমতা অর্জন করতে পারছেন, তাও পেতেন না। ক্ষমতাবানদের চিরাচরিত সুযোগপ্রাধান্যের মধ্যেও ক্ষমতাহীনরা, সীমিত হলেও, কিছু সুযোগ কেড়ে নেওয়ার সুযোগ পান।
কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র তো সুযোগের এই রকম খণ্ডিত বণ্টনের কথা বলে না। তার দাবি সকলের জন্য সমান সুযোগ। সেই আস্থা তৈরি হতে পারে সরকারি স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থাটাকে মজবুত করেই যে ব্যবস্থায় প্রতিটি শিশু শিক্ষার সমান সুযোগ পাবে। এখানে সরকারের ভূমিকাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; শুধু শিক্ষা দফতরেরই নয়, তার সঙ্গে দরকার স্বাস্থ্য, অঙ্গনওয়াড়ি ও পঞ্চায়েতের একটা সমন্বয়মূলক উদ্যোগ। প্রত্যেক শিশু সম্পর্কে সংগৃহীত এই তথ্যভাণ্ডারকে এই কাজে লাগানো যেতে পারে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
বিদ্যালয় শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষার অধিকার আইন বেশ কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন, উল্লিখিত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৪ শতাংশ শিশুর বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ১ কিলোমিটারের বেশি। লক্ষণীয়, কলকাতায় অনুপাতটা ১৭ শতাংশ। আইন অনুযায়ী এ দূরত্ব কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুর ক্ষেত্রেই ১ কিলোমিটারের বেশি হবে না। একই সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ৩১ শতাংশ শিশুর কথা বলার সমস্যা আছে; ১১ শতাংশ দৃষ্টি ও ১২ শতাংশ শোনার সমস্যায় ভুগছে; ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে চলাফেরার অসুবিধা আছে। অপুষ্টির যে ভয়াবহ মাত্রা দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিবন্ধকতাগুলির তার সঙ্গে জোরালো যোগ আছে। এখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য দফতরের ভূমিকাটি খুবই কেন্দ্রীয় শিশু অপুষ্টির একটা বড় কারণ মেয়েদের অপুষ্টি, যার একটা বড় উৎস খাদ্যাভাব, বিশেষত মা ও শিশুদের ক্ষেত্রে। এখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় দায়িত্ব থাকে প্রতিষেধক, নিরাময়মূলক ও স্বাস্থ্যশিক্ষাজনিত কাজকর্মের। পঞ্চায়েত একটা সমন্বয় গড়ে তুলতে পারে।
সরকারি দফতরের কাজগুলি সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সমাজের বড় ভূমিকা থাকতে হয়। তাকে গণতান্ত্রিক দাবিগুলোকে জোরেসোরে তুলে ধরতে হয়। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন: সমাজের ক্ষমতাবান অংশ ক্ষমতাহীনদের জন্য কিছু করতে যাবে কেন? এর উত্তর: অন্যের জন্য নয়, তাদের নিজেদের জন্যই এটা করতে হবে। দেড়শো বছর আগে বঙ্কিম দেখিয়েছিলেন (বঙ্গদেশের কৃষক, ১২৭৯ বঙ্গাব্দ), কী ভাবে ‘শ্রমোপজীবী’ ও ‘বুদ্ধ্যুপজীবী’র মধ্যে ‘গুরুতর সামাজিক তারতম্য’র পরিণামে ‘প্রথম শ্রমোপজীবীদের
১) দারিদ্র,
২) মূর্খতা,
৩) দাসত্ব’ থেকে উদ্ভূত দুর্দশা ‘ক্রমে সমাজের অন্য সকল সম্প্রদায়কে প্রাপ্ত হইল। এক স্রোতে আরোহণ করিয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র একত্রে নিজভূমে অবতরণ করিতে লাগিলেন।’ পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া নিয়ে আক্ষেপগীতি ও শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ হওয়ার একটাই উপায় হতে পারে ‘মানসক্ষেত্রের মরাভূমি’ হওয়া প্রতিরুদ্ধ করা। এর জন্য দরকার এক দূরদৃষ্টির, যা নিকটের পাহাড়, জঙ্গল, প্রেসিডেন্সির বাইরে গিয়ে সমাজের সকল শিশুর সমান বিকাশের সুযোগটাকে কেন্দ্রীয় কর্তব্যের আওতায় নিয়ে আসবে। সমাজের অধোগতি নিয়ে আক্ষেপ দূর করার অন্য কোনও বিকল্প নেই।

প্রতীচী ট্রাস্ট-এ কর্মরত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.