ঈশ্বর কণা কোথায় লুকিয়ে? না কি, ঈশ্বর কণাই ভূত? রহস্যময় ‘নিউট্রিনো’র স্বরূপ সন্ধান করেছেন
বিকাশ সিংহ |
যত দূর জানা যায়, ভূতের বাস্তব অস্তিত্ব কেউ এখনও পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। খুব ছোটবেলায় আমরা এক বিশাল বাড়িতে থাকতাম। সেখানে সন্ধের পর বড় মাপের ছায়া পড়ত। দেওয়ালের ওপর, মশারির ওপর। সেখানে থাকাকালীন ভূতের ভয় থেকে নিস্তার পেতে বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। উনিশ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দিই। শীতের রাতে আলো জ্বেলে ঘুমোতে যেতাম বলে এক সময় প্রচুর টিটকিরি শুনতে হয়েছিল। তখন হঠাৎ এক দিন মনে একটা প্রশ্ন উঠেছিল, ‘আচ্ছা, এই যে ভূত, যদি বিলেতেও তা থেকে থাকে, তা হলে সেটা সাহেব ভূত না আদি অকৃত্রিম বাঙালি ভূত?’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূতের ভয় কাটল, কিন্তু প্রেতের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ রয়েই গেল। পূর্বপুরুষের প্রেত বা অসময়ে-চলে-যাওয়া নিকটজনের প্রেত নিশুতি রাতে যদি আমার সঙ্গে গল্পগাছা করতে আসে, মন্দ কী? দুঃখের কথা, সেই সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি।
রহস্যময় মৌলিক কণা নিউট্রিনো-কে ‘ভুতুড়ে কণা’ বলা হয়ে থাকে। আমার মনে হয় ওই নামটা একেবারেই ঠিক নয়। ভূত নেই, নিউট্রিনো বলে একটা কণা আছে, থাকবে। অবশ্য তার ভর খুবই সামান্য। ভূতের সঙ্গে এর একটাই সাদৃশ্য। একেও দেখা যায় না। তবে এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে আজ দ্বিমত নেই, যদিও সে অস্তিত্বের হদিশ পাওয়া যায় পরোক্ষে। তবে পদার্থবিদ্যার অনেক মৌলিক আবিষ্কারই পরোক্ষে জানান দেয়। নিউট্রিনো এমনই দুঃসাহসী যে, কাউকে কেয়ার করে না, অবাধে যত্রতত্র ঢুকে পড়ে। আর মোটামুটি যে ভাবে ঢোকে, সে ভাবেই বেরিয়ে আসে।
বিংশ শতাব্দীতে নিউট্রিনোর অস্তিত্ব যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেন উলফ্গং পাউলি। এটা তিনি করেন তেজস্ক্রিয়তার একটি বিশেষ ঘটনাকে বোঝার জন্য, যার নাম ‘বিটা ডিকে’। গভীর দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, নিউট্রিনো অদৃশ্য, আর তার বিশেষ ভর নেই। তিনি নিউট্রিনোর অস্তিত্ব অনুমান করতে এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ, তা না হলে প্রশ্ন উঠত পদার্থবিদ্যার ভিত্তি বা কাঠামো নিয়েই। |
পাউলি সাহেবের নিজেরও কিন্তু ভুতুড়ে পরিচিতি ছিল। ট্রেনে ইয়োরোপের নানা স্থানে যাতায়াত করতেন তিনি। তাঁর ট্রেনটি কোনও শহরের স্টেশন পার হওয়ার সময় সেখানকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বা গবেষণার কলগুলি বিকল হয়ে পড়ত। তাঁর সম্বন্ধে এই গল্প এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছয় যে, কোথাও গবেষণার কল বিকল হলেই লোকে ধরে নিত, পাউলি সাহেব সেই শহর ছুঁয়ে গিয়েছেন।
১৯৮৭ সালে পদার্থবিদ্যার জগতে বিরাট আলোড়ন এল। মহাকাশের এক কোণ থেকে অকল্পনীয় মহাবিস্ফোরণের (Supernova Explosion) পরে ১,৬৯,০০০ বছর ধরে সেই বিস্ফোরণের কেন্দ্র থেকে নিউট্রিনো কণা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। তার সন্ধান পেয়ে জাপান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব ক’টি ডিটেক্টর সে দিন দারুণ সজাগ হয়ে উঠেছিল। এর পর যুগান্তকারী আবিষ্কার: নিউট্রিনোর ভর আছে, তবে খুব কম। ব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক কণা, অণু, পরমাণু, নিউক্লিয়াস, প্রোটন, নিউট্রন, মেসন, আবার প্রোটন-নিউট্রনের মাঝখানে অদৃশ্য কোয়ার্ক, এ সব কণা এক নির্দিষ্ট আইন মাফিক আচরণ করে। আইনের পোশাকি নাম স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এটা আসলে অনেকগুলো তত্ত্বের সমষ্টি, যা দিয়ে কণাদের আচরণ খুব ভাল ব্যাখ্যা করা যায়। এই কণামণ্ডলীর আর একটা অংশ হল ইলেকট্রন নিউট্রিনো লেপটনের পরিবার। ১৯৮৭ সালে নিউট্রিনোর ভর থাকার আবিষ্কার ইদানীং কালের কণাবিজ্ঞানের সব থেকে জোরদার ভিত্তি পাথর। এতে ধাক্কা খেল ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’। এ মডেলে নিউট্রিনোর ভর সামলাবার কোনও উপায় নেই।
বলে রাখা ভাল, ঈশ্বর কণা, যেটার আসল নাম হিগ্স-বোসন, তা হল ভর সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা। এই কণার সৃষ্টিকর্তা, অধ্যাপক পিটার হিগ্স-এর বয়স আশির ওপর। সম্প্রতি এই পত্রিকায় লিখেছি, হিগ্স-বোসনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জেনিভার কাছে সার্ন-এর লার্জ হাড্রন কোলাইডার-এ। (‘রয়াল সোসাইটি তাঁকে...’, ৪-৮) এই পরম ঈশ্বরের লুকোবার জায়গাও খুব একটা বাকি রইল না। ঈশ্বর যদি থাকেন, তাঁকেও মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সাকার ঈশ্বর তো মরীচিকা। আর নিরাকার ঈশ্বর তেজ শক্তি ব্যোম ও অনন্ত শূন্যতার মধ্যেই সৃষ্ট ধ্বংস আর সৃষ্টির স্বরূপ। ঈশ্বর কণাও কি সে রকম কিছু?
সেপ্টেম্বরের শেষে এক বিচিত্র ঘোষণা হল সার্ন গবেষণাকেন্দ্র থেকে। ব্যাপারটা এ রকম: সার্ন থেকে নির্গত নিউট্রিনো কণা প্রায় আলোর গতিতে ছুটে যায় ইতালির গ্রান সাসো গুহার দিকে। যে ভাবে প্রতি মুহূর্তে মহাকাশ থেকে ছুটে আসা হাজার হাজার নিউট্রিনো আপনার মাথার ওপর এসে পড়ছে ও চলে যাচ্ছে। এরা কেবল অদৃশ্যই নয়, কোনও কিছুর সঙ্গে মোটে মেলামেশা করে না, নিজের মনে থাকে। যে বলের দ্বারা এরা চালিত হয় সেটি খুবই দুর্বল।
আমরা এ দেশে প্রায় এক দশক ধরে নিউট্রিনো অবসার্ভেটরি তৈরির চেষ্টা করেছি। মহীশূর থেকে প্রায় দেড়শো কিমি দূরে একটা গুহা ঠিক হল। গ্রান সাসো-র মতোই। সেখানে হাতি ও বাঘ আছে বলে আমলারা পরিকল্পনাটি নাকচ করে দিলেন। তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা হল, কোটি কোটি নিউট্রিনো প্রত্যেক জীবের মাথায় পড়ছে, এই অদৃশ্য নায়ক বাঘ, হাতি, কারও কোনও ক্ষতি করবে না। কে কার কথা শোনে? গবেষণাকেন্দ্র তৈরির সময় যে ক’মাস লরি আসবে, তখন হাতি-বাঘের শান্তির ব্যাঘাত ঘটবে। বিজ্ঞানীদের বলা হল, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বিদেয় হন তো বাপু। অন্য এক গুহা দেখা হল। দক্ষিণ ভারতেই। ফাইল গেল আমলাদের হাতে। মিলল না মুখ্যমন্ত্রীর সই।
দশ বছরে কত কী আবিষ্কার হল এই অদৃশ্য কণা নিয়ে। সময় বসে নেই, বসে নেই মৌলিক বিজ্ঞানও। মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর অধ্যাপক, বন্ধুবর নব মণ্ডল নিউট্রিনো নিয়ে বহু দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কিন্তু তাঁরও ধৈর্যের সীমা আছে। আমাদের বাসনা ছিল, নিউট্রিনোগুলো সার্ন থেকে আমাদের নিউট্রিনো গুহায় এসে পৌঁছক। তাতে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতেও বেশ কিছু সুবিধে হত, কারণ এই গুহার দূরত্ব গ্রান সাসোর থেকে অনেক বেশি। কিন্তু বড় মাপের আবিষ্কারগুলো আমাদের কাছে আসার সুযোগ পেল না। আমলাদের দয়ায় বিজ্ঞান তো বসে থাকবে না।
সার্ন থেকে বেরিয়ে গ্রান সাসো পর্যন্ত ধেয়ে-যাওয়া নিউট্রিনোগুলোর (ওগুলির নাম মিউ নিউট্রিনো, মিউ মানে বিড়াল নয় কিন্তু) বেগ সার্ন-এর বৈজ্ঞানিক দল বহু যত্নে নিখুঁত ভাবে মেপে ঘোষণা করেন, ওরা আলোর গতি দশ লক্ষ ভাগের কুড়ি ভাগ ছাড়িয়ে গিয়েছে। সার্ন থেকে গ্রান সাসোর দূরত্ব প্রায় ৭০০ কিমি। এই পথ অতিক্রম করে কণাগুলি গ্রান সাসোতে পৌঁছেছে আলোর তুলনায় ষাট ন্যানোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের এক কোটি ভাগ) আগে।
এ তথ্য যদি সত্যি হয়, তা হলে সেটা আইনস্টাইনকেও বিব্রত করবে। ১৯০৫ সালে তাঁর আবিষ্কৃত E=mc2 এখনও পর্যন্ত সব আবিষ্কারের সেরা বলে গণ্য একটু রদবদল করতে হবে। ওই আবিষ্কারের মূলে একটি তত্ত্ব ছিল যে, বিশ্বে আলোর মতো গতি আর কিছুরই নেই। বিংশ শতাব্দীর যে সব যুগান্তকারী আবিষ্কার, যাদের ওপর ভিত্তি করে আজকের সব অধুনা কারিগরি বিদ্যা দাঁড়িয়ে, তার ভিতটা একটু নড়বড়ে হয়ে যাবে। সব বিজ্ঞানেরই ভিত্তি মোটামুটি ধাক্কা খাবে। যেটা জানতাম, সেটা কি তা হলে সত্যি নয়? তা হলে তো সব আবার নতুন করে শিখতে হবে।
ঘোষণার পরের দিন সার্ন-এর বিখ্যাত অডিটোরিয়ামে বিজ্ঞানী গোষ্ঠীর এক জন এই বিষয়ে একটি লেকচার দেন। যেটা মন দিয়ে শুনলে (ডিভিডি-র মাধ্যমে সার্ন-এর সৌজন্যে) বোঝা যায়, নিখুঁত নৈপুণ্যের সঙ্গে আটঘাট বেঁধে কী ভাবে করা হয়েছে এই জটিল পরীক্ষা। গত মাসেই আবার একই পরীক্ষা করেছেন
সার্ন-এর বিজ্ঞানীরা। ফল একই রকম।
এমন পরীক্ষা ইতিহাসে একেবারে প্রথম নয়। ১৯৭৯ সালে এই বিষয়ে প্রথম গবেষণাপত্র ছাপা হয়, তবে সে পরীক্ষা ছিল লঘু মাত্রায়। ’৮৭ সালে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে দীর্ঘ ১,৬৯,০০০ বছর ধরে ধেয়ে-আসা নিউট্রিনোগুলি ব্যবহার করে যে গবেষণা শুরু হয়, তারও লক্ষ্য ছিল এটা জানা যে, আলোর গতিবেগের তুলনায় অন্য কোনও কণার গতি বেশি কি না। ফল বেরোয় নেগেটিভ।
সেপ্টেম্বরে সার্ন-এ পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা উপলক্ষে বিজ্ঞানীর বিখ্যাত লেকচারের পরে শুরু হল নানা প্রশ্ন। যেমন, ‘পৃথিবী যে চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরছে, দিন থেকে রাত, আবার রাত থেকে দিন, সেটা কি আপনাদের গণনায় ধরা হয়েছিল?’ ‘পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ও চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের যে প্রতিফল, যা থেকে সাগরের জোয়ারভাটার উৎপত্তি, সেটা গণনায় ছিল?’ ‘ভূমিকম্প হওয়ার ফলে পৃথিবীর ওপরের মাটি সরে সরে যায়। ইতালিতে ভূমিকম্প হয়েছে। এই যে মাটি সরে সরে যায়, সেটা কি গণনার মধ্যে ধরেছেন? এ সব প্রশ্নেরই উত্তর মেলে: ‘না’। প্রায় দেড় ঘণ্টা প্রচণ্ড প্রশ্ন-উত্তরের পরে বক্তা বললেন, ‘গ্রুপ এক্সপেরিমেন্ট-টা অন্য জায়গার বিজ্ঞানীরা ভাল করে করুন, সেইটেই আপনাদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ। সে জন্যই আজকের সভা।’ যত দূর জানি, এই পরীক্ষার মতো কিছু একটা করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির জাতীয় গবেষণাগার ‘ফার্মিল্যাব’-এ।
মনীষীদের ছোট করার বদ অভ্যেস আমাদের আছে। তাই বলি, এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর ‘আইনস্টাইন ভুল’ বলে ধুয়ো তুলে নিজেকে ছোট করবেন না। ভবিষ্যৎ গবেষণায় যদি দেখা যায়, সার্ন-এ যা পাওয়া গিয়েছে তা ঠিক, তবুও E=mc2’কে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যাবে না। যেমন, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের আইনগুলি ‘জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’ আবিষ্কারের পরেও ধূলিসাৎ হয়ে যায়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো নিউটনের বদলে আইনস্টাইনের তত্ত্ব কাজে লাগাতে হয়। তবে সেটা কিন্তু রোজ রোজ নয়। বিরাট আবিষ্কারের বিরাট হ্যাপা। সুযোগ পেলে ছিঁড়ে খাওয়ার লোক বিস্তর। তাই নবীনদের উদ্দেশে বলি, এই খেলায় নামতে হলে জানতে হবে কঠিন সমালোচনা কী করে ঠেকাতে হয়। নিউট্রিনোর আবিষ্কার নিয়ে সার্ন-এর প্রকাশিত ডিভিডি থেকে আমি এই বয়সেও নতুন করে শিখলাম কান লাল নয়, মাথা গরম নয়, চাই অসীম ধৈর্য আর সীমাহীন আত্মবিশ্বাস।
ঈশ্বর কণা কোথায় লুকিয়ে? না কি, ঈশ্বর কণাই ভূত? অদৃশ্য, অজানা, জন্মমৃত্যুর রহস্যে ঢাকা সৃষ্টি ও ধ্বংসের মূলেই তো সেই পঞ্চভূত। ঈশ্বর এবং ভূত! না, ঈশ্বর কিংবা ভূত।
হোমি ভাবা অধ্যাপক, পরমাণু শক্তি কমিশন |