‘আসি যাই, মাইনে পাই।’ শুধু সরকারি কর্মচারি নয়, ফাঁকিবাজির এমন অভিযোগ এখন দেশের নীতি-নির্ধারকদের বিরুদ্ধেও।
পঞ্চদশ লোকসভার নবম অধিবেশন শুরু হয়েছে ২২ নভেম্বর। এই ৭ দিনে ৭ ঘণ্টা তো দূরের কথা, সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে ৭০ মিনিটও গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে কিনা সন্দেহ। অথচ, লোকসভা সূত্রে জানা যাচ্ছে, সাংসদরা বিক্ষোভ, ওয়েলে নেমে এসে প্রতিবাদ করে দিনের কাজ পণ্ড করে দিলেও হাজিরা খাতায় সই করতে কিন্তু পিছপা হচ্ছেন না। সংসদ চলুক চাই না চলুক, সইটি করলেই দিনে দু’হাজার টাকা ভাতা পাওয়ার হকদার তাঁরা প্রত্যেকেই।
কংগ্রেসের কিছু নেতা অচল সংসদের জন্যও ভাতা নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বিরোধীরা বলছেন, অধিবেশন চালাতে না পারাটা সরকারেরই ব্যর্থতা। সরকার ও বিরোধীদের এই চাপানউতোরের মধ্যেই দু’টি মূল প্রশ্ন উঠে এসেছে। এক, শুধু লোকসভায় এক দিনের অধিবেশন চালাতে প্রায় দেড় কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। সরকার বা বিরোধী পক্ষ, যাদের কারণেই সংসদ অচল থাকুক না কেন, করদাতাদের টাকা জলাঞ্জলি দেওয়ার অধিকার কি রাজনৈতিক দলগুলির রয়েছে? দ্বিতীয়ত, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে বিতর্কের কারণে মূল্যবৃদ্ধি বা কালো টাকার মতো অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সেই দায় কে নেবে?
এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই আজ ভাতা নেওয়া নিয়ে সরব হন কংগ্রেসের রাজ্যসভা সদস্য মণিশঙ্কর আইয়ার। সংবাদমাধ্যমে তিনি যা বলেছেন, তার নির্যাস একটা সিধেসাপটা প্রশ্ন যে ভাবে দিনের পর দিন সংসদ অচল রয়েছে, তার পরেও কি সাংসদদের দৈনিক ভাতা নেওয়া উচিত? ঘনিষ্ঠ মহলে মণিশঙ্কর জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে আত্মসমালোচনার সময় এসেছে। পাশাপাশি, তিনি সওয়াল করেছেন অবিলম্বে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরুর পক্ষে। তাঁর অভিযোগ, “বিরোধীরাই বিতর্কে রাজি হচ্ছেন না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী-সহ সরকারের কী বক্তব্য, তা জানা উচিত দেশের।”
কংগ্রেসের আর এক সাংসদ দীপেন্দ্র হুডা কড়া ভাষায় বিরোধীদের সমালোচনা করে স্পিকার মীরা কুমারকে একটি প্রস্তাবও দিয়েছেন আজ। প্রস্তাবটি হল, যে সাংসদরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়ে সংসদ অচল করে রাখছেন, তাঁদের দৈনিক ভাতার টাকা তাঁদেরই সাংসদ ভাতা থেকে কেটে নেওয়া হোক। তার পর সেই টাকা জমা পড়ুক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। যাতে সাধারণ মানুষের টাকা জনকল্যাণেরই কাজে লাগে। মণিশঙ্কর বা হুডা আত্মসমালোচনার কথা বললেও, বিরোধীরা কিন্তু অধিবেশন চালাতে না পারার জন্য সরকারকেই দুষছে। বরং তাদের অভিযোগ, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কৌশলে অভিযোগের তিরকে বিরোধীদের দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করছে কংগ্রেস।
গত শীতকালীন অধিবেশনেও কংগ্রেস এমনটাই করেছিল বলে বিরোধীদের দাবি। সে বার যৌথ সংসদীয় কমিটিকে দিয়ে টু-জি কেলেঙ্কারির তদন্ত করানোর দাবিতে একেবারে অনড় ছিলেন বিরোধীরা। সে বারের অধিবেশনে লোকসভায় মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ ও রাজ্যসভায় প্রায় আড়াই শতাংশ সময়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম হতে পেরেছিল। গত আড়াই দশকের মধ্যে এটাই সংসদ ‘চলার’ সব থেকে খারাপ নজির ছিল। সে সময়েও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দৈনিক ভাতা না নেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। বিজেপি তখনও ওই আবেদন খারিজ করে দেয়। আজও এ বিষয়ে বিজেপি সাংসদ মুরলীমনোহর জোশী বলেন, “আমরা সংসদ চালাতে চাই। সরকার মুলতুবি প্রস্তাব মেনে নিলেই স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হতে পারে। প্রায় অর্ধেকের বেশি সাংসদ যখন কোনও একটি প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে, তখন সরকার সেই মনোভাবকে উপেক্ষা করছে। তাই সংসদ চলতে না দেওয়ার দায়টা আমাদের নয়। সরকারের।” আর সিপিএমের রাজ্যসভা সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, “আমরা চাই সংসদ চলুক। আমাদের দলই নির্বাচনের পরে প্রথম বছরে ১০০ দিন সংসদ চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল।” আর ভাতা না নেওয়ার প্রশ্নে? এ ব্যাপারে পিছু হটছেন বাম সাংসদরাও। তাঁদের দৈনিক ভাতার পুরোটাই চলে যায় দলীয় তহবিলে। পরে তা থেকে একটি অংশ পান তাঁরা। |