অচলাবস্থা কাটাতে আজ সংসদে বিরোধীদের আনা মুলতুবি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা বলেছে মনমোহন সিংহের সরকার। সেই প্রস্তাবের ভাষা নিয়ে বিজেপি-কেন্দ্র টানাপোড়েনের মধ্যে যে প্রশ্নটা সব চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তা হল, এ বার কী করবেন তৃণমূল নেত্রী। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে তৃণমূল। কিন্তু এ নিয়ে সংসদে যখন ভোটাভুটি হবে, তখন কি কংগ্রেসের পাশেই থাকবে তার সব চেয়ে বড় শরিক? না কি অনুপস্থিত থেকে প্রতিবাদ জানাবে? অথবা বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার মতো চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
সরকারের শরিক হয়েও তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদের ভিতরে-বাইরে সরব হয়েছেন, তাতে ক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু একই সঙ্গে সরকারের এই সঙ্কটকালে তাঁকে পাশে পাওয়ার চেষ্টাও জারি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ থেকে শুরু করে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী সকলেই চাইছেন, বিষয়টি নিয়ে মমতার সঙ্গে আলোচনা হোক। লোকসভায় ভোটাভুটির সময় তৃণমূল যাতে সরকারের বিরোধিতা না করে, সে জন্য বোঝানো হোক তাঁকে।
কিন্তু কংগ্রেসের অন্দরমহল থেকেই মমতার বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ উঠছে। ২০০২ সালের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে কংগ্রেস নেতাদের একাংশ বলছেন, এনডিএ-র ‘ভিশন ডকুমেন্ট’-এ খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি ছিল। এমনকী ১০০ শতাংশ বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব দিয়ে ক্যাবিনেট নোট তৈরি করেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী মুরাসলি মারান। মমতা তখন এনডিএ শরিক। তখন তিনি প্রতিবাদ করেননি কেন। রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি বলেন, “তখন কি সেটা বুদ্ধিমান ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ছিল, না আজ তিনি বুদ্ধিমান হয়েছেন? আজ তৃণমূল যে ভাবে সরকারের বিরোধিতা করতে ওয়েলে নামছে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না।”
তৃণমূলের পক্ষ থেকে অবশ্য এর জবাবে বলা হয়েছে, সে সময়ে বিষয়টি নিয়ে এনডিএ-র মধ্যে কোনও আলোচনাই হয়নি। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়েও তৃণমূলের সাংসদ ছিলেন। তাঁর কথায়, “মুরাসলি মারান নিজের উদ্যোগে এই প্রস্তাব এনেছিলেন। আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। কিন্তু বিষয়টি জানতে পেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সংসদীয় দলের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন। তখনও তিনি একই রকম বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। শরিকি মনোভাবের আঁচ পেয়ে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।”
কংগ্রেস নেতাদের আরও বক্তব্য, সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা নিজে কলকাতায় গিয়েছিলেন মমতার সঙ্গে কথা বলার জন্য। তখন কেন বিশদে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে নেননি তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব? ফিকি-র জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে মাত্র ক’দিন আগেই যে অমিত মিত্র প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি সমর্থন করেছিলেন, সেই তিনিই আজ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিসেবে এর বিরোধিতা করছেন কেন, এই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। যারা এর সমালোচনা করছেন তাঁরা বিষয়টির গভীরে বিশেষ ঢুকেছেন বলে মনে হয় না।”
তবে মমতাকে আক্রমণ করলেও সরকারের শরিক হিসেবে তাঁর সমর্থনই প্রত্যাশা করছে কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা আজ কংগ্রেস কোর কমিটির বৈঠকে একাধিক বার বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রী। কিন্তু কংগ্রেসকে দুশ্চিন্তায় রেখে মমতা আজও ‘অধরা’। গত দু’দিনের মতো আজও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আজ সন্ধ্যায় তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন আনন্দ শর্মা। সুদীপকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মমতার সঙ্গে আলোচনা করেই এগোতে চান। কিন্তু যে-হেতু মমতাকে পাওয়া যাচ্ছে না, সে-হেতু সুদীপই যেন সরকারের বক্তব্য তাঁকে জানিয়ে দেন। সূত্রের খবর, সুদীপ আনন্দ শর্মাকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর মা গুরুতর অসুস্থ। গত দু’দিন ধরে তিনি হাসপাতালে ব্যস্ত রয়েছেন। তবে সুযোগ পেলেই তিনি (সুদীপ) নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, শুধু খুচরো-বিতর্ক নয়, আরও অনেক বিষয় নিয়েই কেন্দ্রের উপরে মমতা ক্ষুব্ধ। যার অন্যতম হল রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট কাটাতে কেন্দ্রীয় সাহায্য। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে বহু বার দরবার করেছেন মমতা নিজে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত শুকনো আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। এক তৃণমূল নেতার কটাক্ষ, কানিমোঝিকে মুক্তি দিয়ে ডিএমকে-র সমর্থন আদায় করেছে কংগ্রেস। কিন্তু মমতা তো ব্যক্তিগত কোনও সুবিধা চাইছেন না। তিনি সাড়ে তিন দশকের বাম ‘অপশাসন’ থেকে রাজ্যকে মুক্ত করার উপায় খুঁজছেন। এই অবস্থায় মুলতুবি প্রস্তাব নিয়ে মমতা কোন পথে হাঁটবেন, তার সঠিক উত্তর দলের কোনও নেতার কাছেই নেই। তবে দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, গত কয়েক দিন ধরে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধিতাকে যে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার পর আর মুলতুবি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তৃণমূলের বিরোধিতার ফলে সরকারের সামনে সঙ্কট তৈরি হোক, সেটাও চাইছেন না মমতা। ফলে শেষ পর্যন্ত কী করা হবে, তা নিয়ে এখনও মনস্থির করেননি তিনি। তবে ভোটাভুটির সময় লোকসভায় অনুপস্থিত থাকার একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। |