পরিষেবায় ত্রুটি হলেই আঙুল ওঠে প্রশাসনের দিকে। কিন্তু, উপযুক্ত পরিষেবা পেয়েও যখন জনসাধারণ মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ান?
নির্দিষ্ট বাসস্টপে যাত্রী-প্রতীক্ষালয় নেই। থাকলেও দাঁড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ নেই এত দিন এটাই ক্ষোভ ছিল শহরবাসীর। বর্তমান পুরবোর্ডের উদ্যোগে শহরের বেশ কিছু জায়গায় তৈরি হয়েছে সুসজ্জিত বাস-ছাউনি। তবু বাস ধরতে সেই রাস্তার মাঝখানে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন যাত্রীরা। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি যাত্রীদের সদিচ্ছার অভাবই এ ক্ষেত্রে দায়ী?
শহরের সৌন্দর্যায়নে সম্প্রতি বর্তমান পুরবোর্ড প্রায় ২৯১টি পুরনো যাত্রী প্রতীক্ষালয়কে রাতারাতি আধুনিকীকরণের কথা ঘোষণা করে। পুরসভার আগের নিযুক্ত সাত-আটটি বিজ্ঞাপন সংস্থাকেই ওই আধুনিকীকরণের ভার দেওয়া হয়। প্রতিটি বাস-ছাউনি তৈরির খরচ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। কাজের খরচও বহন করতে বলা হয় ওই এজেন্সিগুলিকেই। সেই মতো কাজও শুরু করে তারা। ইতিমধ্যেই শহরের বেশ কিছু বাসস্টপে সেই কাজ শেষ। আলোয় মোড়া বেশ কিছু প্রতীক্ষালয়ে সেজে উঠেছে শহর। অথচ, রোদে অথবা জলে-কাদায় মাখা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রীদের প্রতীক্ষার ছবিটা একটুও বদলায়নি। এর জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে শহরবাসীর দুই ধরনের অসহযোগিতাকেই। |
বাসস্টপ নয়, পথেই দাঁড়িয়ে অধিকাংশ যাত্রী। ছবি: সুমন বল্লভ। |
বাস-ছাউনি আধুনিকীকরণের দায়িত্বে থাকা এজেন্সিগুলির তরফে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়ছে পুরসভায়। যার সিংহভাগই মানুষের অসহযোগিতার। অভিযোগ, রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের সামনে বাসিন্দাদের বাধায় আটকে গিয়েছে ছাউনির কাজ। সমস্যা রয়েছে হাজরা মোড়ে বসুশ্রী সিনেমার সামনেও। নতুন নিয়মে, আধুনিক ডিজাইনের বাস-ছাউনির পিছন দিকটা ঢাকা থাকার কথা। সেখানে শুধু পুরসভাই লাগাতে পারবে মনীষীদের ছবি, উদ্ধৃতি। ফলে দোকান আড়াল হয়ে ব্যবসার ক্ষতির ভয়ে দোকানের সামনে বাস-ছাউনি করতে বাধা দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে জনবহুল রাস্তাতেও তাই নতুন বাস-ছাউনি হতে পারছে না।
পিছনে ফাঁকা পড়ে আলোকিত বাস-ছাউনি। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে রাস্তার উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা। এ ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় বহু বার দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনকে দায়ীও করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা নেননি শহরবাসী।
যাত্রী-প্রতীক্ষালয় ব্যবহারে কেন এমন অনীহা জনগণের? বেশির ভাগ যাত্রীর দাবি: যাত্রী তুলতে যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে পড়ে বাস। অথচ, নির্দিষ্ট জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। তাই বাস ধরতে রাস্তার উপরে এগিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। আর এক দল যাত্রীর অভিমত: প্রতীক্ষালয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয় না। কোথাও কোথাও বাস ছাউনির পথ আগলে রয়েছে অটোস্ট্যান্ড। কোথাও সংলগ্ন দোকানপাট, হকারের জন্যও সমস্যা হচ্ছে। যদিও অটোচালকদের বক্তব্য, যে সব জায়গায় আগে থেকেই অটোস্ট্যান্ড ছিল, সেগুলি সেখানেই আছে। নতুন করে বাস-ছাউনি তৈরির সময়ে কেউ তাদের সরতে বলেননি। এক বাসচালক সাফ বলেন, “যাত্রী যেখানে দাঁড়াবে, আমরা তো সেখানেই থামব। ওঁরাই ছাউনি ছেড়ে বাস ধরার জন্য রাস্তার উপরে এগিয়ে দাঁড়ান। এতে আমাদেরও বাস চালাতে সমস্যা হয়।” এই অসচেতনতার কথা মানছেন কিছু সাধারণ মানুষও। তাঁদের বক্তব্য, বাস-ছাউনির নীচে অপেক্ষমাণ যাত্রী দেখলে বাস সেখানে থামতে বাধ্য। তাঁদের কাজই তো যাত্রী তোলা।
তবে কি শহরবাসীর একাংশের অনমনীয় মনোভাবের জন্যই এ ভাবে ব্যর্থ হবে সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনা? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, “মানসিকতার পরিবর্তন অবশ্যই জরুরি। যানজট এড়িয়ে গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া মানুষকে অনিয়মের দিকে চালিত করে। মানুষের সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, শহর সাজাতে শুধু প্রশাসন নয়, তাঁদেরও বড় ভূমিকা আছে।”
কলকাতা পুরসভার বিজ্ঞাপন বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, এজেন্সি সংস্থাগুলির সঙ্গে পুরসভার কিছু তালমিলের অভাবে কোথাও কোথাও আধুনিক ছাউনি বসানোর ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ত্রুটি-বিচ্যুতির পুনর্মূল্যায়নের কাজ চলছে। ট্রাফিক পুলিশের কাছে শহরে বাসস্ট্যান্ডের তালিকা চাওয়া হয়েছে। শীঘ্রই তা পুরসভার হাতে চলে আসবে। সেই অনুযায়ী ছাউনি সরানো শুরু হবে।
কিন্তু হকার বা বাসিন্দাদের বাধাকে কী ভাবে মোকাবিলা করবে কলকাতা পুরসভা? এ বিষয়ে মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার বলেন, “আইন তৈরি করা পুরসভার কাজ নয়। তবে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করা হবে। আমাদের কাজ জনগণের কাছে উন্নত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। কিছু মানুষের কথা ভেবে পুরসভা বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করবে না। তবে প্রতীক্ষালয়ের যথাযথ ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে শহরবাসীকে অবশ্যই কিছু ভূমিকা নিতে হবে। নতুন প্রতীক্ষালয় তৈরির কাজ আগামী ছ’মাসের মধ্যে পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।” |