বিনোদন শৈশবের টান সঙ্গী করেই বাঙালির টিনটিন দর্শন
টুনটুনির নয়, টিনটিনের বই।
তোপসের জবানিতে এ ভাবেই বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এর কিছু দিনের মধ্যেই ‘আনন্দমেলা’-র পাতায় বাঙালির কৈশোরের সঙ্গী হয়ে আবির্ভাব ঘটবে ডানপিটে সাংবাদিকের। এই গঙ্গাপারের দেশে লাল-ঝুঁটি বিদেশিকে, চেনানোটা মোটেই সোজা কাজ ছিল না।
সাড়ে তিন দশক বাদে ছবিটা বেমালুম পাল্টে গিয়েছে। রুপোলি পর্দায় স্টিভেন স্পিলবার্গের থ্রি-ডি টিনটিনের মুক্তির পরে কেটে গিয়েছে তিন সপ্তাহ। ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন: দ্য সিক্রেট অফ দ্য ইউনিকর্ন’ নিয়ে বঙ্গদেশে মাতামাতিতে তাবড় মাল্টিপ্লেক্স-কর্তা থেকে ফিল্মি পরিবেশককুলের মুখে চওড়া হাসি। এ দেশে ছবিটি যাঁরা নিয়ে এসেছেন, সেই সোনি পিকচার্স ইন্ডিয়ার হিসেব, ভারতে রেকর্ড গড়তে চলা অ্যানিমেশন ছবিটির টানে মুম্বই-বেঙ্গালুরুকেও টেক্কা দিচ্ছে কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গে টিনটিনের পরিবেশক ওম মুভিজ-এর দেবাশিস ঘোষের মতে, শিলিগুড়িও ভালই পাল্লা দিচ্ছে। আইনক্স-ফেমের মতো মাল্টিপ্লেক্স-কর্তাদের দাবি, অন্তত তিরিশ পেরোনো বড়রাই সিনেমা হলের আশি ভাগ ভরিয়ে তুলছেন।
প্রশ্নটা এখানেই। এ কি নিছকই কোনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারের নতুন ছবি দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়া? নাকি হঠাৎ পাওয়া টাইম মেশিনে চড়ে তিন-সাড়ে তিন দশক আগের সেকেলে কৈশোরে ডুব? সেলুলয়েডের টিনটিনকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বা ভিন রাজ্যে বঙ্গজদের তুমুল উৎসাহ দেখে অনেকেরই দ্বিতীয় কারণটাই জোরদার বলে মনে হচ্ছে। বাস্তবিক আজকের ৩৫-৪০ কি ৫০ ছুঁই ছুঁই বাঙালিরা অনেকেই স্পিলবার্গের টিনটিনের নাম শোনা ইস্তক সত্তর কি আশির দশকের নস্টালজিয়ায় মশগুল। ফেসবুক, মোবাইল তথা কম্পিউটার গেমস-বিহীন শৈশবে নতুন ‘আনন্দমেলা’ এলেই যখন গোগ্রাসে টিনটিনের পাতাটা শেষ করতে ভাই-বোনে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত!
এ ব্যাপারে কিন্তু গোটা দেশে তর্কাতীত ভাবে বাংলা ‘ফার্স্ট’। অন্য কোনও ভারতীয় ভাষা বেলজিয়ান সাহেব জর্জ রেমি বা অ্যার্জে-র জনপ্রিয় কমিকসকে আত্মীকরণের কথা তখনও ভাবেনি। মূল ফরাসির ত্যাঁত্যাঁ থেকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত টিনটিন বড়জোর তার বছর দশেক আগে এ দেশের বাজারে ঢুকেছে। টিনটিনের ফুটফুটে কুকুর মিলু বা স্নোয়ি এর পরেই আনন্দমেলা-য় কুট্টুস হয়ে উঠবে। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের উদ্ভট গালাগালি ‘বিলিয়নস অব ব্লিস্টারিং বার্নাকল্স’-এর অনুসরণে সে দিনের খুদেরা ‘জলের পোকা’, ‘উড়ুক্কু মাছ’ বা ‘বিদঘুটে বকচ্ছপ’ বলে ঝগড়া করতে শিখবে। ‘আনন্দমেলা’ পড়তে পড়তে বড় হওয়া প্রজন্ম এক বাক্যে স্বীকার করে, টিনটিনই এক মাত্র বিদেশি যে ফেলুদা-টেনিদা-হাঁদা-ভোঁদাদের মতোই বাঙালির ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিল। ক্লাসে একটু খাড়া-খাড়া চুলের ছেলেটার তখন অবধারিত টিনটিন নাম হয়ে যেত। সাদা লোমওলা পোষা-কুকুর মানেই কুট্টুস। আবার রাতদিন পড়াশোনা করার ‘বদনাম’ থাকলে ‘প্রোফেসর ক্যালকুলাস’ বলে আওয়াজ খেতে হত।
‘আনন্দমেলা’র সে কালের সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মনে পড়ে যাচ্ছে, তৎকালীন ম্যানেজিং এডিটর অভীক সরকারের উৎসাহে কী ভাবে ত্যাঁত্যাঁ-র বঙ্গীকরণ করে ধারাবাহিক ভাবে টিনটিন প্রকাশ শুরু হয়েছিল। ব্রাসেলসে গিয়ে অ্যার্জের সঙ্গে দেখা করে তাঁর ইন্টারভিউ আদায় করেছিলেন অভীকবাবু। পুরনো পাঠকদের অনেকের মনে আছে, ওই সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রতিবেদনও পরে ‘আনন্দমেলা’ ছেপেছিল।
জীবৎকালে সত্তরের দশকের শেষ দিকে কলকাতা থেকে খুদে ভক্তদের চিঠি পেতে অভ্যস্ত ছিলেন অ্যার্জে। অধুনা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, ইন্দ্রনীল সান্যাল তাঁর কিশোর বয়সে টিনটিন-স্রষ্টাকে চিঠি লিখে জবাব পেয়েছিলেন। স্পিলবার্গের ছবির আবির্ভাবের দিনেই সাইবার-দেওয়ালে সেই ‘অমূল্য’ এরোগ্রামটির ছবি তিনি সগর্বে ‘পোস্ট’ করে দিয়েছেন। মধ্য চল্লিশের ইন্দ্রনীলের কথায়, “তখন ঘরে ঘরে অত বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকত না। টিনটিন-হ্যাডকদের সঙ্গী হয়েই আমরা গুপি-বাঘার মতো হাততালি দিয়ে বরফের দেশ থেকে মরুভূমি কি সমুদ্রে পাড়ি দিতাম।”
বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে কে নেই টিনটিনের ভক্তদের তালিকায়? চলচ্চিত্রকার সন্দীপ রায়ের স্মৃতিতে, বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে টিনটিন পড়ার অভিজ্ঞতা। টিনটিনের অন্ধ ভক্ত সত্যজিৎ ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’-তে লিখেও গিয়েছেন, ‘রহস্য, রোমাঞ্চ, সাসপেন্স আর মজায় ভরপুর এমন কমিকস আর দু’টি মিলবে না।’ টিনটিন নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের মতটাও এর থেকে আলাদা নয়। তোপসে-ফেলুদার মতো সুনীলবাবুর সন্তুও টিনটিনের ফ্যান। শীর্ষেন্দুবাবুর মতে, “অ্যাডভেঞ্চার থাকলেও টিনটিনে নিষ্ঠুর রক্তপাত নেই। ভিলেনরাও আদপে মজার। ছোটদের জন্য এমন কাহিনি চমৎকার।”
সবারই মত, ‘আনন্দমেলা’ই টিনটিনকে বাঙালির আরও কাছে নিয়ে আসে। আজ সেই টিনটিন যখন পর্দায়, সেই ছবি টিনটিনের সঙ্গে বাঙালির পুরনো ভালবাসাবাসিই উসকে দিচ্ছে। ‘আনন্দমেলা’র টিনটিনে মুগ্ধ কলকাতার এক পুলিশ-কর্তা সুপ্রতিম সরকারের কথায়, “অনেক বছর বাদে ফেলুদার ছবি রিলিজ-এর সময়েও এমনটা হয়েছিল। টিনটিনের ফিল্মের পোস্টারটাও যেন আমাদের এক টুকরো সোনার ছেলেবেলা ফিরিয়ে দিচ্ছে।”
শৈশবের সেই টিনটিন আর স্পিলবার্গের তৈরি টিনটিনের মধ্যে একটা সংঘাতও কি তৈরি হচ্ছে ?
বেলুড়ের পদার্থবিদ্যার স্কুলশিক্ষক শুভাগত বন্দ্যোপাধ্যায় টিনটিনের তিনটি কাহিনিকে মেলানোয় স্পিলবার্গের মুন্সিয়ানার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ঠিকই। কিন্তু তার পাশাপাশি পর্দায় থ্রি-ডি কৃৎকৗশল, রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চারে মজলেও অনেকেরই স্পিলবার্গের টিনটিনকে পুরোপুরি টিনটিন বলে মানতে দ্বিধা আছে।
‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ডের অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও গদ্যকার সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনেরই ছোটবেলায় ‘আনন্দমেলা’র সূত্রেই মাতৃভাষায় টিনটিনের সঙ্গে আলাপ। বাংলা টিনটিনের দুরন্ত মজায় এখনও বিভোর সঙ্গীতার কথায়, “ছবিটা টানটান হলেও কমিকসের পাতায় ভুসভুসিয়ে ওঠা হাসিটা কম পড়েছে।” আর অনিন্দ্য তো গানই বেঁধেছিলেন, ‘বাজে বকা রাত্রি দিন, অ্যাসটেরিক্স-টিনটিন/ এলোমেলো কথা উড়ে যেত হাসির ঠেলায়’! স্পিলবার্গের চিত্রনাট্যে অ্যার্জের আপনভোলা প্রোফেসর ক্যালকুলাস বাদ পড়ার বিষয়টা অনিন্দ্য ভাল চোখে দেখছেন না মোটেও। সাবেক আনন্দমেলা-প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অনেকেরই এখনও টিনটিনের যে কোনও কাহিনি ঠোঁটস্থ। চেটেপুটে সেলুলয়েডের স্বাদ নিলেও অনেকের ভোটই অ্যার্জের ধীর লয়ের মজাদার কমিকসের সঙ্গে থাকছে।
থাকছে বিতর্ক। কিন্তু স্পিলবার্গের দৌলতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মাঝবয়সীদের প্রোফাইল ছবিতেও হঠাৎ টিনটিন-হ্যাডকদের উঁকিঝুঁকি। আনন্দ পাবলিশার্সে বছরভরই বাংলা টিনটিনের কাটতি দারুণ। ফিল্ম রিলিজ-এর পরে সেই ঝোঁকটা আরও বেড়েছে। সে দিনের শিশু বা কিশোর, আজকের মা-বাবারা দায়িত্ব নিয়ে বাচ্চাদের সিনেমাটা দেখিয়ে আনছেন।
নেপথ্যে সেই টিনটিনের বই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.