রুগ্ণ সদ্যোজাতের চিকিৎসা
দৃষ্টান্ত গড়ে নিজেই থমকে গিয়েছে পুরুলিয়া
ন্মের সময়ে বান্দোয়ানের শিবানী কিস্কুর ছেলের ওজন ছিল সাকুল্যে সাড়ে আটশো গ্রাম! বাঁচার আশা প্রায় ছিলই না। আছাড়িপিছাড়ি কাঁদতে কাঁদতে ছেলে কোলে শিবানী হাজির হয়েছিলেন তাঁদের ‘ভরসাস্থলে।’
ভরসাস্থল, অর্থাৎ পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে গড়ে ওঠা নবজাতক চিকিৎসাকেন্দ্র। যে কিনা সুষ্ঠু পরিকল্পনা, পরিচর্যা ও তার সাফল্যের জোরে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ‘নজির।’ জেলাস্তরে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলে কী ভাবে রুগ্ণ ও কম ওজনের সদ্যোজাতকে বাঁচানো যায়, তার পথ দেখিয়ে সে ‘মডেল’ হয়ে উঠেছিল অন্যদের কাছে।
অথচ ‘মডেল’ হওয়া সেই পুরুলিয়া এখন নিজেই কিছুটা থমকে গিয়েছে! তার দেখানো পথ অনুসরণ করে অন্যান্য
রাজ্য যখন পরিকাঠামোয় এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তারই পায়ে যেন বেড়ি! কেন?
কারণ নানাবিধ। সবই পরিকাঠামোকেন্দ্রিক। যেমন, শয্যা বাড়েনি। বেশ কিছু যন্ত্র অচল হয়ে পড়েছে, উপরন্তু আধুনিক কোনও সরঞ্জামও আসেনি বলে অভিযোগ। চাহিদামতো চিকিৎসক-নার্সও দেওয়া হয়নি। ফলে নানা ভাবে হোঁচট খাচ্ছে পরিষেবা।
এখনও ভরসার জায়গা। ছবি: সুজিত মাহাতো
কিন্তু ২০০৩-এ কেন্দ্রটি চালু হল যখন, তখন চারপাশের দিশাহীন আঁধারে সে-ই হয়ে উঠেছিল ‘আলোর দিশারী।’ তথ্য বলছে, তখন অধিকাংশ জায়গায় সদ্যোজাতের চিকিৎসার আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণ শিশুবিভাগে ঠাঁই হওয়ায় তাদের সংক্রমণের শিকার হওয়াটা ছিল প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। ওয়ার্মারের বালাই ছিল না বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, সময়ের আগে জন্মানো রুগ্ণ শিশুদের দু’শো ওয়াটের বাল্বের নীচে রেখে দেওয়া হতো। তাতে উষ্ণতা মিললেও চড়া আলোয় ‘স্ট্রেস’ বাড়ত দুধের বাচ্চাদের।
এই পরিস্থিতিতে দৃষ্টান্ত গড়েছিল পুরুলিয়া। রুগ্ণ নবজাতকের চিকিৎসায় ইউনিসেফ ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে সম্পূর্ণ আলাদা কেন্দ্র (সিক নিউবর্ন কেয়ার সেন্টার, সংক্ষেপে এসএনসিইউ) খোলা হয় দেবেন মাহাতো-য়। আসে রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার, সঙ্গে ফোটোথেরাপি ইউনিট, ডিজিট্যাল স্কেল, পাল্স অক্সিমিটার, সিরিঞ্জ পাম্প, এবিজি মেশিন, ইলেকট্রোলাইট অ্যানালাইজার, পোর্টেবল এক্স-রে। প্রত্যন্ত জেলায় অক্সিজেন সরবরাহের সমস্যা মেটাতে চালু হয় ‘সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই।’ এইট পাশ মেয়েদের তালিম দিয়ে ‘স্পেশ্যাল নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
ফলও মিলতে থাকে হাতে-নাতে। পুরুলিয়ার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বীরভূম-কোচবিহার-বাঁকুড়া-নদিয়া-উত্তর দিনাজপুরে ওই আদলে এসএনসিইউ খোলা হয়। বিহার, ওড়িশা, রাজস্থান-সহ দেশের কিছু রাজ্যও একই পথে হাঁটে। এমনকী, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, মলদ্বীপেও ‘পুরুলিয়া মডেলে’ রুগ্ণ সদ্যোজাতের চিকিৎসা শুরু হয়।
কিন্তু সেই পুরুলিয়ার কী অবস্থা, এক বার দেখা যাক।
এখানকার এসএনসিইউয়ের ১৪টি শয্যার জন্য এত দিন ছিলেন মাত্র তিন জন চিকিৎসক। হালে চতুর্থ জন এসেছেন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, চব্বিশ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চালানোর পক্ষে চার জন নেহাতই অপ্রতুল। শুধু তা-ই নয়। হাসপাতাল-সূত্রের খবর: ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার গত পাঁচ বছর অকেজো। ইলেকট্রোলাইট অ্যানালাইজারও দীর্ঘ দিন কাজ করছে না। ভেন্টিলেটর নেই। এমনকী, কম ওজনের শিশুকে বাঁচাতে সি প্যাপ (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ার প্রেশার) নামে যে যন্ত্রটি একান্ত জরুরি, আট বছরেও তা মেলেনি। চালু হয়নি নিওনেটাল ওয়ার্ড।
‘পুরুলিয়া মডেল’-এর রূপকার, এসএসকেএমের নবজাতক চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রধান অরুণ সিংহ বলেন, “আশপাশের জেলা তো বটেই, ঝাড়খণ্ড থেকেও রোগী আসছে। অবিলম্বে ওখানে বেড বাড়িয়ে অন্তত ৪০ করা দরকার। ডাক্তার বাড়াতে হবে। যন্ত্রগুলো দ্রুত সারাতে হবে। সীমিত পরিকাঠামোতেই অসাধারণ পরিষেবা দিচ্ছেন এখানকার ডাক্তার-নার্সরা। পরিকাঠামোর উন্নতি হলে আরও বহু মানুষ উপকৃত হবেন।”
ওই কেন্দ্রের চিকিৎসকদের বক্তব্য, চল্লিশটা এক্সটেন্ডেড নিওনেটাল বেড’ তৈরির সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলেই অনেক লাভ হবে। কর্তৃপক্ষ কী বলেন?
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, “আমাদের অনেক ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। এই মুহূর্তে বেড হয়তো খুব বেশি বাড়ানো যাবে না, কারণ নতুন বাড়ি লাগবে। তবে অবিলম্বে ভেন্টিলেটর পাঠানো হচ্ছে। অকেজো যন্ত্র দ্রুত বদলানো হবে।”
তবে নানা সমস্যার মধ্যেও একটা জিনিস এখানে অটুট। চিকিৎসক-কর্মীদের মনোবল ও সদিচ্ছা।
এবং তারই জোরে এটি এখনও বহু মানুষের ভরসাস্থল। তারই দৌলতে মাসখানেক বাদে হাসিমুখে ছেলে কোলে বাড়ি ফেরেন শিবানী কিস্কু। ছেলের ওজন প্রায় দু’কিলো! ডাক্তারদের প্রশংসায় ওই আদিবাসী বধূর মতোই পঞ্চমুখ বহু বাচ্চার মা-বাবা। যাঁরা একবাক্যে জানাচ্ছেন, এখানকার ডাক্তারবাবু-নার্সরা প্রাণপাত করেন। চার চিকিৎসক প্রদীপকুমার ভকত, সুদীপ্ত দাস, বিকাশ পাল ও দেবীপ্রসাদ সিংহ মহাপাত্র তো আছেনই, ওয়ার্ডের ১৫ জন নার্সও পালা করে বুক দিয়ে আগলাচ্ছেন তাঁদের সন্তানদের। মা ছাড়া কেউ ওয়ার্ডে ঢুকতে পারেন না। মাকেও প্রতি বার সাবানে হাত ধুয়ে, গাউন পরে ঢুকতে হয়। কেউ আপত্তি করেন না। ২০০৯-এ এখানে ৩৪৯টি শিশু ভর্তি হয়েছিল, মৃত্যু হয় ২৩ জনের, ২০১০-এ ৩৭৩ জনের ৩১ জন মারা গিয়েছে। চলতি বছরে সেপ্টেম্বর ইস্তক ভর্তি ২২৯ জনের মধ্যে মৃত্যু ২৬টি।
রাজ্যে শিশুমৃত্যু কমাতে টাস্ক ফোর্স গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্যোগ ও সদিচ্ছার জোরে পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জেলাতেও শিশুমৃত্যুর হার ৫৪% কমাতে পেরেছে যে কেন্দ্র, তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকার এ বার কী করে, সেটাই দেখার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.