|
|
|
|
|
|
পড়া শুরুর আগে... |
বাণিজ্যিক সাফল্যেও নৈতিকতা জরুরি |
যে কোনও ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘কর্পোরেট এথিক্স’ বিশেষ জরুরি। আর নতুন প্রজন্মেরও
এই নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আলোচনা করছেন চন্দনা চন্দ্র |
সাম্প্রতিক কালে ভারতের অর্থনীতিতে দুর্নীতির দু’টি বড় ঘটনা হল টু জি স্পেকট্রাম ও সত্যম কেলেঙ্কারি। কর্পোরেট সেক্টরে নৈতিকতার অভাব যে কতখানি গভীর, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই ঘটনাগুলো। উসকে দিয়েছে অনেকগুলি প্রশ্ন। বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা কি আদতে দুর্নীতিরই ফসল? প্রশ্ন উঠছে বি-স্কুলগুলির ভূমিকা নিয়েও। ম্যানেজমেন্ট কোর্সের কারিকুলামে ‘এথিক্স’-এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব যে কতখানি, তাও বুঝিয়ে দিয়েছে ওই ঘটনাগুলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের কর্পোরেট সেক্টরে দুর্নীতি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে ১৯৯০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উদারীকরণ নীতি ঘোষণার পর থেকে। গত দু’দশকে অনেক ভারতীয় কোম্পানিই দেশের মধ্যে নিজের ব্যবসাবৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নিজেদের অস্তিত্ব তৈরি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সংস্থার মুনাফা বাড়াতে এদের অনেকেই অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করছে।
ভারতের অন্যতম নামকরা বিজনেস স্কুল জামশেদপুরের এক্সএলআরআই-এর অধিকর্তা ফাদার ই আব্রাহাম জানালেন, কম সময়ে অত্যধিক মুনাফার তাড়নায় আমেরিকার অনেক ফার্ম ও ফিনানশিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানই সাস্টেনেবল বিজনেস-এর বেসিক নিয়মনীতি না-মেনে একগাদা দায়িত্বহীন ব্যবস্থা নেয়, যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে মার্কিন ও বিশ্ব অর্থনীতিতে। এর ফল হল আজকের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক মন্দা।
এখন প্রশ্ন হল, ভারতের বিজনেস স্কুলের গ্র্যাজুয়েটরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কী কারণে? নতুন দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট-এর অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামস-এর ডিন হিমাদ্রি দাসের মতে, ‘দ্রুত উন্নতি করতে চাওয়া ছেলেমেয়েরা ‘শর্টকাট রুট’ বেছে নিচ্ছে। কঠিন পরিশ্রম করার ধৈর্য এদের নেই। ঠিক পথে শীর্ষে পৌঁছনোর জন্য যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাও তারা দিতে চায় না।’
অনেকের মতে, এগুলি আসলে এই সময়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিরই প্রতিফলন। ‘ক্যাট’ পরীক্ষার মাধ্যমে বিজনেস স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের মধ্যে এমনিতেই একে অপরের প্রতি একটি কম্পিটিটিভ মনোভাব থাকে। অন্যকে পেছনে ফেলে কী ভাবে নিজে এগিয়ে যাওয়া যায়, সব সময়ে সেই ভাবনা থাকে ছাত্রদের মধ্যে। অন্য দিকে, অনেকেই পড়ার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ১২-১৫ লক্ষ টাকা ঋণ নেয়। আর কোর্স শেষে সেই ঋণের মাসিক ১৮-২০ হাজার টাকার কিস্তি ঘাড়ে চাপে তাদের। স্বভাবতই তারা হাই-প্যাকেজের চাকরির দিকে ছোটে। সেখানেও তো তীব্র প্রতিযোগিতা। তাই, চাকরি পেয়ে গেলে সেটাকে বজায় রাখতে এদের যা যা করতে বলা হয়, তাই-ই করে। আর এ ভাবেই ক্রমশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েরা। ‘তবে এর মধ্যেও ভাল পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের মজ্জাগত মূল্যবোধ দুর্নীতির থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে’, জানালেন কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট-এর অধিকর্তা সৌম্যেন্দ্রনাথ রায়। |
|
আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে বিজনেস স্কুলগুলির ভূমিকা নিয়ে। ইউ জি সি অনুমোদিত ম্যানেজমেন্ট কোর্সের কারিকুলামে ‘বিজনেস এথিক্স’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কোনও বিজনেস স্কুলে বিষয়টি ‘ম্যানেজমেন্ট ইথস অ্যান্ড প্র্যাকটিস’, কোথাও ‘বিজনেস এথিক্স অ্যান্ড কর্পোরেট সিটিজেনশিপ’, আবার কোথাও ‘এথিক্স অ্যান্ড বিজনেস’ নামে পড়ানো হয়। তা সত্ত্বেও এই নীতিশিক্ষা ছাত্রদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না কেন?
এর বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন, অধিকাংশ ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত বিষয়ে পিএইচ ডি অথবা কর্পোরেট জগতে দীর্ঘদিন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাই ‘এথিক্স’ পড়ান। ম্যানেজমেন্ট ও এথিক্স দু’টি বিষয়েই স্পেশালাইজেশন রয়েছে এমন শিক্ষক নেই বললেই চলে।
বিজনেস এথিক্স-এর শিক্ষার উদ্দেশ্য হল, সেই সব ধারণা ছাত্রদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া, যার ফলে তারা নিজের বা সংস্থার মুনাফার খাতিরে কোনও ভুল বা অনৈতিক কাজ করার আগে দু’বার ভাবে। তবে দুঃখের বিষয় হল যে ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলিতে এমন অনেক শিক্ষক থাকেন, যাঁরা মুখে এথিক্সের পাঠ পড়ালেও নিজেরাই সেগুলোতে বিশ্বাস করেন না। শুধু ফ্যাকাল্টি কেন, প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই নৈতিকতার অভ্যাস থাকা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গভর্নর্সকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁরাই অধিকর্তার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে নৈতিকতার অভ্যাস গড়ে তোলার নির্দেশ দেবেন। উপযুক্ত পরিবেশেই ছাত্রদের মধ্যে এথিক্সের শিক্ষা ফলপ্রসূ হবে। সৌম্যেন্দ্রবাবুর মতে, ‘শিক্ষক নিয়োগের সময়ও স্বজনপোষণ বা পক্ষপাতিত্ব না করে উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিকেই নিয়োগ করতে হবে। ইন্টারভিউয়ের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রার্থীর নৈতিকতার দিকটাও খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
অবশ্য পারিবারিক মূল্যবোধ না থাকলে বা স্কুলে নৈতিকতার যথার্থ পাঠ না পড়ে থাকলে, শুধু মাত্র দুই বছরের ম্যানেজমেন্ট কোর্সে বিজনেস এথিক্স পড়িয়ে কাউকে পুরোদস্তুর বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। দেখা যায়, সমস্ত ভাল পরিবারেই কিছু সুশিক্ষা, সুসংস্কার থাকে। এই মূল্যবোধগুলোই তাদের সন্তানকে কোনও রকমে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হতে বাধা দেয়। ‘আমাদের ছোটবেলায় আমরা রোল মডেল হিসেবে গাঁধীজি, নেতাজি, চিত্তরঞ্জন দাস এঁদের পেয়েছিলাম। নৈতিকতা বোধ আমাদের মধ্যে পরিবার থেকেই গড়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে এই সব মহান ব্যক্তিত্বদের চোখের সামনে দেখা, তাঁদের কথা শোনা, পড়া, আমাদের মনের মধ্যে এথিক্স গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল’, বললেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কোঝিকোড়-এর অধিকর্তা দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। এখনকার প্রজন্মের এমন কোনও আইকন নেই, যার দ্বারা তারা নৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এর সঙ্গে ঢুকে পড়েছে আধুনিক ‘কনজিউমার কালচার’ বা ভোগবাদী সংস্কৃতি। আর তারই ফলশ্রুতি আজকের পরিস্থিতি।
বিজনেস এথিক্স-এর সঙ্গে অনেকগুলি বিষয় যুক্ত। যেমন, সাস্টেনেবিলিটি, ইকুয়াল ডিস্ট্রিবিউশন, এনভায়রনমেন্টাল হারমোনি ইত্যাদি। সমাজকে তোমার ব্যবসার উদ্বৃত্ত লাভ ফিরিয়ে দিতে না পারলে দীর্ঘ দিন ব্যবসা টিকে থাকবে না। এটাই হল কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি। ফাদার আব্রাহাম-এর মতে, ‘ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন ব্যবহারে নৈতিকতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অভ্যাস থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকেও সময়
সব শেষে বলা যায়, নৈতিকতার প্রকৃত শিক্ষা শিশুকাল থেকেই শুরু হওয়া উচিত। পরিবার ও স্কুলের ভূমিকাই এ ক্ষেত্রে প্রধান। পরিবারের সদস্যদের সৎ ও দায়িত্বশীল আচরণই একটি শিশুকে ভবিষ্যতে এক জন নৈতিক ও দায়িত্ববান নাগরিক গড়ে তুলতে পারে। সরকারকেও নীতিনির্ধারণের সময় যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে, যাতে তা কেবলমাত্র সর্বশিক্ষা নয়, সুশিক্ষাতেও সহায়ক হয়। বিশ্বায়নের যুগে সব কিছুতেই প্রতিযোগিতা। কিন্তু প্রতিযোগিতায় জেতবার জন্য কোনও অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা উচিত নয়। বিজনেস এথিক্স বলে তুমি নিজে যত দূর পর্যন্ত পারো ঘুড়ি ওড়াও, কিন্তু আকাশে অন্যদেরও ওড়াতে দাও। তোমার ধারালো মাঞ্জা দিয়ে অন্যের ঘুড়িটা কেটে দিয়ো না। সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উত্তরণ হোক। অন্যায় ভাবে বা দুর্নীতির হাত ধরে নয় এই শিক্ষাই ছড়িয়ে দিতে হবে
সকলের মধ্যে। |
|
|
|
|
|