নিঃশব্দে পার হয়ে গেল বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ! তেমনই উদাসীনতা রয়ে গেল মুর্শিদাবাদের প্রত্নস্থাপত্য সংরক্ষণ নিয়েও।
গত ১৯-২৫ নভেম্বর বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ পালন করেছে হাজারদুয়ারি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ইতিহাস-সমৃদ্ধ এই জেলায় বিভিন্ন অবহেলিত প্রত্নস্থাপত্য নিয়ে এই সময়েই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদেরা। তাঁদের মত, জেলার কিছু ঐতিহাসিক স্মারক ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের তরফে অধিগ্রহণ করা হলেও তার বাইরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পুরাসম্পদ। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (কলকাতা মণ্ডল) অবসরপ্রাপ্ত অধিকর্তা বিমল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলা ঐতিহাসিক দিক থেকে দারুণ ভাবে সমৃদ্ধ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্মারক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের চেষ্টা রয়েছে সংস্কার-সংরক্ষণ করার। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে ওই কাজ সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে।” |
বেশ কিছু সুপ্রাচীন ভবন দেখা যায় এই জেলার নানা প্রান্তে। কিন্তু সেগুলি কী প্রয়োজনে কে কখন তৈরি করেছিলেন, তা জানা যায় না। প্রবীণ ইতিহাস গবেষক বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এএসআই এবং রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্মারক অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণে উদ্যোগী হলেও সংখ্যার দিক থেকে তা নগণ্য। তার বাইরেও জেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পুরাতত্ত্ব সামগ্রী। মুর্শিদাবাদ জেলার ৩০০ বছর উদযাপনের সময় হেরিটেজ বিল্ডিং-এর একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তের পুরাকীর্তিগুলি সংরক্ষণের জন্য তালিকাও তৈরি হয়। কিন্তু তা সংস্কার বা সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।”
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, মোগল, পাঠান ছাড়াও বিদেশি বণিক হিসেবে আগত পর্তুগিজ, ফরাসি, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ ও ইংরেজদের ধর্মীয় প্রভাবও এখানে পড়ে। তবে রাঢ় এলাকায় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচলন ছিল বেশি। চৈতন্য পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মের একটা জোয়ার উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়। সুলতানি আমলের পরে পরধর্ম সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জৈনরা ধর্মাচরণের জন্য নিজেদের উপাস্য দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। এছাড়াও ষোড়শ শতাব্দী বা মোগল-পাঠান আমল থেকে এই জেলায় মসজিদ নির্মিত হতে থাকে এবং তার বিস্তার ঘটে হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও নবাবি আমলে (১৭০৪-১৮৮১)। ফলে মন্দির-মসজিদ-গির্জার নির্মাতা হিসেবে রাজা-মহারাজা, নবাব-বাদশা, জমিদার-জোতদার, বণিক, সমাজের ধনী ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছে।
বিজয়বাবু বলেন, “খেরুর মসজিদ জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। এরকম অনেক মন্দির-মসজিদ ও পুরাকীর্তি রয়েছে, যা সংস্কার করা দরকার। যদিও বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে বিভিন্ন পুরাসম্পদগুলির ইতিহাস ধরে রাখা এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা সংরক্ষণ বা সংস্কারের কোনও চেষ্টা হয়নি। ফলে ২৫০-৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে চিরকালের মত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার ইতিহাসও।” তবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে মুর্শিদকুলি খাঁ-এর কন্যা আজিবুন্নেষার সমাধি, রেসিডেন্সি সমাধি, রানি ভবানির মন্দির, চার বাংলা মন্দির-সহ শিব মন্দির, মিরমদনের সমাধি, ডাচ সমাধি, পুরনো ইংরেজ সমাধি, আলিবর্দি খান ও সিরাজদ্দৌলার সমাধি, সুজাউদ্দিনের সমাধি, মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধি ও কাটরা মসজিদ, জাহানকোষা কামান, হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও ইমামবাড়া, সংগ্রহশালা, দক্ষিণ দরওয়াজা, হলুদ মসজিদ, সাদা মসজিদ, ত্রিপোলিয়া গেট, নীলকুঠি, কর্ণসুবর্ণ অধিগ্রহণ করে সংস্কার ও সংরক্ষণের বন্দোবস্ত হয়েছে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করেছে আজিমগঞ্জের গঙ্গেশ্বর শিবমন্দির, ভট্টবাটির শিবমন্দির, কান্দিতে যজ্ঞেশ্বর শিবমন্দির, পাঁচথুপিতে পঞ্চয়াতন শিবমন্দির। সরফরাজ খাঁ-এর সমাধি তালিকায় থাকলেও এখন পর্যন্ত সংস্কার হয়নি। |