উদ্বেগ জানালেন মাওবাদী নিয়ে
চিনের প্রভাব রুখতে নেপাল সফরে প্রণব
কূটনীতির দৌড়ে চিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে নেপালকে পাশে পাওয়ার চেষ্টায় নামল মনমোহন সরকার।
ক’দিন পর, ডিসেম্বরেই বিশাল প্রতিনিধি দল নিয়ে নেপালে আসছেন চিনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। তার ঠিক আগেই কাঠমান্ডুতে সংক্ষিপ্ত সফরে এসে ভারতের পতাকা উড়িয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। নেপালের সঙ্গে দ্বৈত কর ব্যবস্থা এড়ানোর সংশোধিত চুক্তি সই করে গেলেন, যা এই হিমালয় রাষ্ট্রে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করবে। সম্ভব হবে দু’দেশের মধ্যে কর ও ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত তথ্যের আদানপ্রদান। এবং জানা যাবে কালো টাকার লেনদেন সম্পর্কেও। ভারতের ঘরোয়া রাজনীতিতে এখন যা এক অতি-গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। তবে এটা যে নিছকই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর সফর নয়, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই এই সফরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গী হওয়ায়। এ দিন নেপালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রতিটি বৈঠকেই হাজির ছিলেন মাথাই।
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির উপরে প্রভাব বাড়ানো এবং নয়াদিল্লিকে চাপে রাখার একটি নির্দিষ্ট নকশা বরাবরই কাজ করে চিনের কূটনীতিতে। সম্প্রতি দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতীয় সংস্থার তেল উত্তোলনে বাধা দেওয়া, দলাই লামার প্রসঙ্গকে সামনে এনে সীমান্ত আলোচনাকে পিছিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনায় এই মূহূর্তে ভারত-চিন কূটনৈতিক উত্তাপ যথেষ্ট বেড়ে রয়েছে। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বেশি সক্রিয় রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাই এখন ভারতের নীতি। কাঠমান্ডুর নেতাদের আজ মূলত সেই বার্তাটিই দিয়েছেন প্রণববাবু। আরও এক বার তাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “ভারত চায় নেপালে শান্তিপ্রক্রিয়া যথাসময়ে শেষ হোক, মজবুত হোক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম
সাহায্য করবে কেন্দ্র।” জানিয়েছেন, ভারত-বিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ, বিশেষ করে মাওবাদী সন্ত্রাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হবে নেপালকেও।
নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরন যাদবের সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়।
কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক আধিপত্য বাড়াতে ভারত ও চিনের মধ্যে ‘বাফার’ দেশগুলিতে ঢালাও বিনিয়োগ করে যাচ্ছে বেজিং। বুদ্ধদেবের জন্মস্থান লুম্বিনীকে কেন্দ্র করে প্রচুর অর্থব্যয়ে ‘লুম্বিনী সার্কিট’ করে দেওয়াকেও চিনের সক্রিয় কূটনৈতিক উদ্যোগ বলেই মনে করছে ভারত। জিয়াবাওয়ের সফরে তাদের সেই তৎপরতা আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা। তার আগেই ভারত-নেপাল আর্থিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে প্রণববাবুর এই সফর। সংশোধিত দ্বৈত কর ব্যবস্থা এড়ানোর চুক্তি (ডিটিএএ)-তে সই হওয়ার কথা ছিল গত অক্টোবরে। নানা কারণে তা পিছিয়ে দিতে হয়। এই চুক্তির ফলে ভারতীয় শিল্পসংস্থা ও বিনিয়োগকারীরা নেপালে লগ্নি বাড়াতে আরও সাহসী হবে বলে আশা করছেন প্রণববাবু। নেপালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ৪৭.৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। তবু নেপাল যাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চিনের দিকে না ঝুঁকে পড়ে তার জন্যই বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত।
ভারত ও নেপালের মধ্যে সংশোধিত দ্বৈত কর ব্যবস্থা এড়ানোর চুক্তি হয়েছিল ১৯৮৭ সালেই। কিন্তু ১৯৯১ সালে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করে সংশোধন করা হল চুক্তিতে। আগের চুক্তিতে কর বা ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের সুযোগ ছিল না। প্রণববাবু জানিয়েছেন, নতুন চুক্তির ফলে কালো টাকার লেনদেন হচ্ছে কি না তা জানা যাবে এবং হলে সেটা বন্ধ করারও ব্যবস্থা করা যাবে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলিকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য জোগাতে নেপালকে নানা ভাবে কাজে লাগিয়েছে বেজিং। ভারত ও নেপালের মাওবাদীদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে ধারাবাহিক তথ্য এসেছে নর্থ ব্লকের কাছে। আর এই ‘যোগাযোগে’ চিনের পরোক্ষ ছায়াও দেখা গিয়েছে। নেপালের সামরিক বাহিনীকে বিপুল অর্থ সাহায্য করা, পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়ার কাজেও ক্রমশ সক্রিয় হচ্ছে চিন। তাই তাদের প্রধানমন্ত্রীর নেপাল সফরকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সাউথ ব্লক।
বারো বছরের মধ্যে এই প্রথম চিনের কোনও প্রধানমন্ত্রী পা রাখবেন কাঠমান্ডুতে। তার আগে এ দেশের বিদেশমন্ত্রী নারায়ণ কাজি শ্রেষ্ঠ গিয়েছেন চিনে। এই পরিস্থিতিতে শুধু নেপালের প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই বা অর্থমন্ত্রী বরসামান পানের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বৈঠক নয়, বিদেশসচিবকে সঙ্গে নিয়ে প্রণববাবু আজ লাগাতার বৈঠক করে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামবরণ যাদব, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড এবং এ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। প্রণববাবুরা আজ যে বার্তাটি তাঁদের দিয়েছেন তা হল, মাওবাদী সন্ত্রাস নিয়ে ভারতের উদ্বেগ বুঝতে হবে নেপালকে। উত্তরপূর্বাঞ্চলের অস্থিরতাকে প্রশমিত করতে পরোক্ষ সহায়তা করতে হবে দিল্লিকে। প্রণব মুখোপাধ্যায় নেপালি নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, অথবা ভুটানের মতো নেপালের উপরেও নয়াদিল্লি অনেকটাই নির্ভরশীল। নেপালে শান্তিপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হলে, অর্থাৎ মাওবাদী ক্যাডারদের পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামিল করা গেলে, তা যে আখেরে ভারতের নিরাপত্তার জন্যও শুভ সংকেত সে বিষয়টিও আজকের বৈঠকে তুলে ধরেছেন প্রণববাবু।
এ দেশের নেতারাও জানিয়েছেন, আদালতের আদেশ অনুসারে আগামী সাড়ে ছ’মাসের মধ্যে সংবিধান রচনার কাজ শেষ করতে হবে। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সময় বয়ে যাচ্ছে, কাজের কাজ হচ্ছে না। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ভারতকে পাশে প্রয়োজন নেপালেরও। প্রণববাবু এ দিন তাঁদের স্পষ্টই জানিয়েছেন, সহায়তার হাত বাড়াতে ভারত কোনও কার্পণ্য করবে না।
বিভিন্ন সময়েই নেপালে আসতে হয়েছে বর্ষীয়ান নেতাকে। আজ তাই বাবুরামের সঙ্গে বৈঠকের পর রসিকতা করে প্রণববাবু বলেন, “আমি ততটা প্রবীণ নই! কিন্তু নেপালের ব্যাপারে যা অভিজ্ঞতা, তাতে যথেষ্ট পরিণতই বলা যায় আমাকে।” চিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে এই ‘পরিণত’ নেতার অভিজ্ঞতাকেই আজ কাজে লাগালেন মনমোহন সিংহ।

কূটনীতির দৌড় হিমালয়ে
• বিদেশ সচিবকে সঙ্গে নিয়ে দিনভর বৈঠক
• ফের আশ্বাস, সব রকম সাহায্য করবে দিল্লি
• দ্বৈত কর এড়াতে নতুন করে চুক্তি
• নেপালে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়ার আশা
• বিনিময় হবে কর ও ব্যাঙ্ক আর্থিক তথ্য
• মিলবে কালো টাকা লেনদেনের হদিসও



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.