|
|
|
|
|
|
|
নষ্ট নীড় |
শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় নানাবিধ গুঞ্জন।
এস্রাজের সুরে মিশে যায় দীর্ঘশ্বাস। এক জন প্রৌঢ়। অন্য জন যুবতী।
স্বামী-স্ত্রী নন, সহচর।
সম্পর্কের বিচিত্র আখ্যান। পড়লেন শোভন তরফদার
|
এই কাহিনির শুরুটা ঠিক কোথায়, বা কী ভাবে, তা খুব স্পষ্ট করে বলা কঠিন। অনুমান করা চলে শুধু। অনুমান করা চলে, তিনি দেখেছিলেন, দিগন্তে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। দুপুরবেলার নিঃসঙ্গতার মতো মেঘ। বাবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হয়েছেন প্রায় দশককাল হয়ে গেল। পড়ে আছে বিশ্বভারতী। সেই বিশ্বভারতীর রাশ তাঁরই হাতে, অথচ, তিনিই কি না ঘোর একলা।
না কি, একলা নন! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নামসংক্ষেপে রথী ঠাকুরের রক্তে একটি মায়া। তিনি এস্রাজে ছড় টানেন, সুর ওঠে। সেই সুর কি বাতাসে ভেসে উত্তরায়ণ থেকে ধেয়ে যায় শ্রীপল্লীর দিকে? শ্রীপল্লীর পাঁচ নম্বর বাড়িটির দিকে?
বিশ্বকবি, কবিগুরু, গুরুদেব এমন নানা বিশেষণের পুষ্পরাজি যাঁর পায়ে সমর্পিত, সেই মহামহিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিলাভের পরে প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রমে ক্ষয়ে যেতে থাকেন একটি গোপন টানে।
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না, একটি গানে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রথী ঠাকুর যেন দেখতে পান, এ গান যেখানে সত্য, সেখানে বয়ে চলে শীর্ণ কোপাই, পথপাশে ঘন ছায়া, আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, এবং কপালে সিঁদুর!
সিঁদুরের কথা মনে পড়তেই এস্রাজে সুর উতলা হয়! সীমন্তচিহ্নই প্রমাণ, সেই নারীটি পরস্ত্রী। শান্তিনিকেতনে প্রথম যুগের আশ্রমিক এবং পরবর্তী কালে বিশ্বভারতীর শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘকালের পরিচিত। সেই নির্মলচন্দ্রেরই তরুণী স্ত্রী, মীরা। পূর্বনামে মীরা বিশী, নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে বিবাহের পরে মীরা চট্টোপাধ্যায়। এই বিবাহ নিয়ে তখন শান্তিনিকেতনে কিছু বাধাও এসেছিল, পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে তা দূর হয়।
রথীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘশ্বাস এস্রাজের সুরে মিশে যায়। কেন যে মন ভোলে, তা মন জানে না। শুধু এটুকু জানে যে এই মুহূর্তে তাঁর মানসপটে আর কেউ নেই। কিছু নেই। আছে দু’টি উজ্জ্বল, ঘনকৃষ্ণ চক্ষু। মীরা। আছে বিচিত্র একটি সম্পর্ক। যে সম্পর্কের দাবিতে ছোট্ট একটি হাতচিঠিতে লেখা যায়:
‘মীরা,
ডাক্তার বাবু বলেছিলেন আজ sponging নিতে। সুপূর্ণা ঠিক পারে না তাই তোমার যদি অসুবিধা না থাকে তবে কি একবার ১১টার কাছাকাছি এসে এটা করতে পারবে? আমি সকালে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলুম। জানি না তোমার অভ্যাস আছে কি না যদি অসুবিধা না থাকে তো এস মিনিট দশ-পনেরোর জন্য। তোমার উপর খুবই অত্যাচার করছি।
রথীদা।’
হাতচিঠি এখানেই ফুরোয় না, নীচে জুড়ে থাকে আরও একটি বাক্য।
‘যদি অভ্যাস না থাকে তো জানিও আমি নিজে ম্যানেজ করে নেব। সঙ্কোচ কর না।’
কিন্তু, আসলে ঠিক কাকে বিহ্বল করে সঙ্কোচ? পত্রলেখককেই কি নয়? পুনশ্চের মতো একটি বাক্য জুড়ে দিতে হয় কেন? বিশ্বভারতীর উপাচার্যের লেটারহেড-এ এক প্রৌঢ় পুরুষ তাঁর অঙ্গ-চর্যার জন্য ডাকছেন সদ্য ত্রিশ-পেরোনো এক যুবতীকে। যদিও সেই কাজ অসুস্থের চিকিৎসা-সংক্রান্ত, তবু আমন্ত্রণটিই তো ঈষৎ অ-স্বাভাবিক! গত শতকের মধ্যভাগের সমাজ-সম্পর্কের বিচারে তো বটেই, এমনকী এখনও, এই একুশ শতকী বঙ্গভূমেও, এমন চিঠি চার পাশে বেশ কিছু ভ্রু কুঞ্চিত করবে, নিশ্চিত! কী কথা তাহার সাথে? কেনই বা ডাক দেওয়ার পরে কয়েকটি শব্দে সহসা একটি দূরত্ব জাগিয়ে রাখার প্রয়াস? অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও কাছে থেকে দূর রচনার আলতো একটি খেলা?
|
|
কেনই বা তার স্বামী নির্মলচন্দ্রকে আর একটি ছোট্ট হাতচিঠিতে জরুরি কাজ নিয়ে বসার কথা জানিয়ে রথীন্দ্রনাথ লেখেন:
‘কাল সকালে কফি টেবিলে কথা হতে পারে যদি তোমরা এস’।
রথীদা’
সর্বনামের নীচে নজরটান তাঁরই দেওয়া, পাছে তাও চোখে না পড়ে, তাই অন্তিমে আরও দু’টি বাক্য জুড়তে হয়, ‘বহুবচনটা লক্ষ্য রেখ। আমাকে দোষের দায় ফেল না।’
কেন ‘তোমরা’? কাজ তো নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-তে একটি অনুষ্ঠান নিয়ে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সঙ্গে এক শিক্ষকের জরুরি কিছু আলাপ। সেখানে ‘বহুবচন’টি কেন? স্বাভাবিক, প্রাতরাশের আমন্ত্রণ একলা শিক্ষকটিকেই করা হয়তো সৌজন্যের বিরোধী, বিশেষত তিনি যখন এই নবীন দম্পতিটির খুবই ঘনিষ্ঠ...
কিন্তু, শুধুই কি ‘সৌজন্য’?
শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা?
টুকরো টুকরো চিঠিতে ছড়িয়ে থাকে এই ‘বহু’-বচন!
‘কাল ছুটি, তায় আজ চাঁদনী রাত। অশেষকে বলেছি এস্রাজ নিয়ে আসতে। আহারাদির পর ৮টা-৯টার মধ্যে তোমরা দু’জনে এস যদি বাজনা শুনতে ভাল লাগে।’
‘সন্ধ্যাবেলাটা একলা ভাল লাগে না। দেখেছ তো কেওই বড় আসে না। তোমরাও কি আসবে না?’
‘যদি বিশেষ অসুবিধা বোধ না কর তবে আজ রাত্রিতে যদি এস তবে খুসী হব। অনেক উপকার পেয়েছি তোমাদের কাছ থেকে তাই লোভও অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। তোমাদের বেশি লেখা বাহুল্য। এটা নিতান্তই ছেলেমানুষী আবদারের মত তোমাদের মনে হবে, না?’
‘নিতান্তই ছেলেমানুষী’ বুঝি?
তা হলে শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় কেন ওড়ে নানাবিধ গুঞ্জন?
কেন জীবন্ত একটি প্রশ্নচিহ্নের মতো জেগে থাকেন আর এক নারী?
বয়সে রথীন্দ্রনাথের তুলনায় সামান্য ছোট। সম্পর্কে তাঁর সহধর্মিণী। ঠাকুর পরিবারের প্রথম ‘বিধবা’-বধূ। প্রতিমা দেবী।
‘কোণার্ক’ ভবনে তাঁর নিভৃত বাস। উত্তরায়ণের যে পম্পা সরোবরের ধারে রথীন্দ্রনাথের দারু-কর্মের স্টুডিও ‘গুহাঘর’, তারই উপরে প্রতিমা দেবীর স্টুডিও ‘চিত্রভানু’! গুহাঘরেই থাকেন রথীন্দ্রনাথ। অথচ দু’জনের সাক্ষাৎ নেই।
কী করেই বা থাকে? যে শান্তিনিকেতন একদা পরিহাস করে বলত, বিশ্বভারতী কোথায়, এ তো ‘বিশ্ব বা রথী’, সেখানেই জনতার কানে কানে ভাসে আর একটি নাম।
‘রামী’। ‘মীরা’ নয়, ‘রামী’!
চকিতে প্রাচীন এক প্রেমকথার অনুষঙ্গ জেগে ওঠে, আবার মিলিয়েও যায় লোকজনের বাঁকা হাসির মধ্যে! বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীনই একবার হাজারিবাগ যান রথীন্দ্রনাথ। সহচর ছিলেন নির্মলচন্দ্রের স্ত্রী মীরা। শান্তিনিকেতনের আকাশবাতাস বিদ্রূপে, সমালোচনায় তিক্ত হয়ে ওঠে।
সে কথা কি বোঝেন না প্রাজ্ঞ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর? তখনও গণমাধ্যম এমন সর্বত্রগামী নয়, পাপারাৎজির দল তাঁকে তাড়া করেনি, কিন্তু মুখরোচক এমন একটি সংবাদ গোপন থাকেনি। রথীন্দ্রনাথের বোন, মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় মেয়ে নন্দিতাকে একটি চিঠিতে লিখছেন:
‘রোজই কাগজ খুল্লে একটা আশঙ্কা হোত যে না জানি ওখানকার বিষয় কি লিখে বসে। একদিন Blitz কাগজে দাদার হাজারিবাগ যাওয়া নিয়ে বেশ স্পষ্টই লিখেছিল শুধু দাদার নামটা দেয়নি। বিশ্বভারতীর কাজ ছেড়ে দিলে সে দিকে আর কোনও দুশ্চিন্তা রইল না যে কে কি ছেপে দেবে Private Life-এ যা খুশী করতে পারবেন সে দিক দিয়ে আরো স্বাধীন হলেন কারোর বলবার কিছু রইল না।’
সজ্ঞানেই হোক, বা অজান্তে, বোন মীরাই ধরিয়ে দেন অগ্রজ রথীন্দ্রনাথের জীবনে নিহিত সংকট! এক দিকে বিশ্বভারতী, জনসমাজ, বিপুল দায়িত্ব। অন্য দিকে, Private Life, ব্যক্তিগত জীবন। এক দিকে ইতিহাসের চাপ, ভাবমূর্তির দায়। অন্য দিকে, লুকোনো বেদনা।
যতই দেখি তারে ততই দহি আপন মনজ্বালা নীরবে সহি, তবু পারিনে দূরে যেতে...
অতঃপর?
তিক্ত, বিষণ্ণ রথীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখলেন:
‘আমাকে চলে যেতেই হবে এই কলুষিত আবহাওয়া ছেড়ে। আমার সামান্য যেটুকু পুঁজি আছে তাতে জীবনটা আয়েসে না হলেও কোনোরকমে চলে যাবে। টাকার চেয়ে যেটা বেশি দরকার মনে করি সেটা হচ্ছে একটু যত্ন ও সমবেদনা। এটা বলতে আমার লজ্জা হয় কিন্তু বয়স ও স্বাস্থ্যের কাছে হার মেনেছি। আমার এই দুর্বলতার জন্য তোমার কাছে অসম্ভব দাবি করেছি যা আমার আত্মীয়দের কাছেও করি নি, করতে ইচ্ছাও করে না।’
গুহাঘরের নিভৃতে বসে নির্মলচন্দ্রের কাছে কী ‘অসম্ভব দাবি’ রাখার কথা ভাবেন রথীন্দ্রনাথ? উত্তরায়ণের নিকটে পম্পা সরোবরের স্থির জল এলোমেলো হয় সহসা। এস্রাজ মৌন হয়।
তার ছিঁড়ে গেছে কবে, সে খোঁজ কে-ই বা রাখে?
রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁরই অতি স্নেহভাজন এক শিক্ষকের পত্নীর সঙ্গে পাড়ি দেন দূর দেশ। দেরাদুন। সঙ্গে সেই নবীনার মা ছিলেন যদিও, জনরব তাতে মন্থর হয়নি একটুও। স্বামী নির্মলচন্দ্র বিশ্বভারতীতেই কর্মসূত্রে নিয়োজিত। কন্যা জয়িতাও বিশ্বভারতীর ছাত্রী। মীরা চট্টোপাধ্যায় আছেন দূরে। রথীন্দ্রনাথ এবং মা কমলা দেবীর সঙ্গে। দেরাদুন-এ।
তাঁদের নতুন বাড়ির নাম, ‘শেষের কবিতা’-র অনুষঙ্গে, ‘মিতালি’।
নির্মলচন্দ্রের নীরবতা বিস্ময়কর এবং প্রলম্বিত। ছুটিতে তিনিও যাচ্ছেন সেখানে। ফিরেও আসছেন শান্তিনিকেতনে। কিন্তু, এই ত্রিভুজের গভীরে কি থেকে যায় আরও কিছু? শুধুই কি নির্মলচন্দ্রই যান দেরাদুনে? দূর থেকে কি আরও বেশ কিছু উৎসুক চক্ষু অপলকে সেই বাড়ির দিকে তাকায় না?
রথীন্দ্রনাথের বোন মীরা দেবী মেয়ে নন্দিতা কৃপালনিকে চিঠিতে লিখছেন:
‘বৌঠানের সঙ্গে দাদার চাক্ষুষ দেখা হয়নি তবে মুসুরি যাওয়া আসার পথে দাদা যেখানে আছেন বাড়ীটা দু দিন বার দেখেছেন। বারান্ডা থেকে নতুন শাড়ী ঝুলছে তাও দেখছেন। রামকৃষ্ণ আশ্রমের কাছে জমি কিনে নতুন বাড়ী তৈরি করছেন দুজনে মিলে তদারক করতে যান তাও শুনেছেন।... এখন বুঝছি যে বাবার নাটকগুলোর জবাই করে সে টাকায় রামীর জন্যে নতুন প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। কালিংপংএর বাড়ীর ভিতরে যে সব কাঠের কাজ আছে তার ডিজাইন ও মাপ জোপের খাতা সুবলকে পাঠাতে লিখেছেন। বুঝলুম যে এটা রামীর আবদার রাখবার জন্যে যাতে চিত্র-ভানুর চেয়ে তার বাড়ী কোন অংশে খাটো না হয়। সম্ভব হলে বোধহয় দ্বিতীয় আর একটা উদয়ন করে ফেলত তবে অত টাকা বোধহয় এখন নেই। আশ্চর্য্য ক্ষমতা রামীর, কোন যোগ্যতা না থেকেও শেষ পর্যন্ত বৌঠানের উপর টেক্কা মারল। দেরাদুনে দাদার ছবির একজিবিশন হচ্ছে শুনে মুসুরি যাবার পথে বৌঠান সেখানে একবার নেমেছিলেন দাদার আঁকা ছবির পাশে রামীর আঁকা ছবি পাশাপাশি ঝুলছে দেখলেন। আর কি চাই বল?’
সহসা মনে হতেই পারে, আশ্চর্য কোনও চিত্রনাট্য! চলন্ত গাড়ি থেকে পথের পাশে, কিছুটা দূরে একটি বাড়ির দিকে সতৃষ্ণ চেয়ে আছেন যিনি, তাঁরই স্বামী সেই গৃহের বাসিন্দা। আছেন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে। সঙ্গে অন্য এক নারী। লং শটে দেখা যায় সেই বাড়ির বারান্দায় দোদুল্যমান একটি শাড়ি। সেই বস্ত্রের ঝকঝকে অবয়ব থেকে ঠিকরে আসে রৌদ্র। গাড়ি এগিয়ে যায়।
মাথার ভিতরে, গম্ভীর পেন্ডুলামের মতো একটি শাড়ি দুলে চলে। অবিরাম।
প্রতিমা দেবী ননদের মেয়ে নন্দিতাকে লেখেন:
‘কী ভয়ঙ্কর মেয়ে মানুষ শান্তিনিকেতনে আমাদের পাসা পাসি ছিল তা কখন পূর্ব্বে তো ভাবিনি।...আমার নিজের চেয়েও তোর মামার জন্যই কষ্ট আজ আমি পাচ্ছি। কী মতিভ্রম হোল নিজের কাজ কর্ম সব ছেড়ে ঐ একটা অতি অর্ডিনারী টাইপের মেয়ের সঙ্গে চলে গেলেন, মানুষের কত পরিবর্তন হয় তাই ভাবি।’
যে নারীকে নিয়ে এই বিস্ময়কর আখ্যান, তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং রথীন্দ্রনাথের কী ধারণা? দু’টি চিঠি দাখিল করা চলে দৃষ্টান্তবশত।
নির্মলচন্দ্রকে লিখছেন রথীন্দ্রনাথ:
‘মীরার মধ্যে হাল্কা-হাসির দিক ছাড়াও যে গভীরতা আছে, যা সকলের চোখে পড়ে না, সেইটা না থাকলে বা আমি যদি না বুঝতে পারতুম তবে আমার এতটা ভাল লাগত না। আমার মনে হয় লোকে মীরাকে ভুলই বোঝে।’
এ বার মীরাকে লেখা তাঁর চিঠির একটি টুকরো:
‘যা চাচ্ছিলুম, যার অভাবে মন অসাড় হয়ে গিয়েছিল তোমার মধ্যে তা দেখতে পেয়ে অন্তরাত্মা উল্লসিত হয়ে উঠল। একটুও দ্বিধা বোধ হয় নি...আমি তৃপ্ত হলুম, নিঃসঙ্গ জীবন সঙ্গী পেল, নিজেকে ধন্য বোধ করলুম। বাইরের জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেল তোমার মধ্যেই আমার সমস্ত জগৎ পেয়ে গেলুম।’
দেরাদুনে একটি নিভৃতবাস ছাড়া বাকি সমূহ জগৎ অদৃশ্য হোক, এই আকাঙ্ক্ষাটি রথীন্দ্রনাথের তদানীন্তন মানসিক পরিস্থিতির পক্ষে অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। ঘটেওনি। ফলে নির্মলচন্দ্রকে চিঠিতে লিখতে হয়: ‘আমাদের তিনজনের মধ্যে যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকে তবে সেটা মর্মান্তিক বেদনাদায়ক হবে।’ কিংবা ওই চিঠিতেই আর এক জায়গায় তাঁর বক্তব্য: ‘মীরা যে আমার মন অধিকার করেছে তার মধ্যে সন্তান স্নেহ, মাতৃভক্তি এবং অকৃত্রিম অকলুষ ভালবাসা সব মেশান আছে। এ কথা কি তুমি জান না?’
পাশাপাশি থাক মীরা চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠি: ‘তোমারি সব, আমার কিছু নয়। আমার কেবল মীরু আছে সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড। তাকে ছাড়া আমি কিছুই নই আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি নিজেকেও সঁপে দিয়েছি।’
আশ্চর্য এই সমর্পণ! মাঝে মাঝে দেরাদুন থেকে শান্তিনিকেতনে আসেন রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে মীরা। কানাকানি চলে, প্রতিমা দেবী চলে যান নিঃশব্দ অন্তরালে, রথীন্দ্রনাথ অবিচলিত। আবার মীরা চট্টোপাধ্যায় যখন স্বামী নির্মলচন্দ্রকে ‘নিমু আমার’ সম্বোধন করে একটি চিঠি লেখেন, তখন সেই কাগজেই থাকে রথীন্দ্রনাথের লেখা একটি সংযোজন। সংযোজনটি কেন সেখানেই থাকে, কেন অন্য পত্রে নয়, সেই প্রশ্নটি অবশ্য বিশেষ অসঙ্গত নয়।
উত্তর মেলে না।
রথীন্দ্রনাথের নিজস্ব দাম্পত্য জীবনের কথা মনে আসে প্রসঙ্গত। সেখানেও কি ব্যক্তিগত কোনও পরিসর রচনা করে নিতে পেরেছিলেন তাঁরা? পারলেও, কতটা পেরেছিলেন? সুপ্রসিদ্ধ পিতৃদেবের ছায়ায় গ্রস্ত তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যায় নিরন্তর নিয়োজিত। ‘আমার রাস্তা দিয়ে যে তোমাদের জীবনের পথে তোমরা চলবে এ কথা মনে করা অন্যায় এবং এ সম্বন্ধে জোর করা দৌরাত্ম্য’, এ কথা প্রতিমা দেবীকে লিখছেন বটে রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু বাস্তবে কি অনেকটা সে রকমই ঘটল না রথী এবং প্রতিমার যুগল-জীবনে?
এর সঙ্গে যুক্ত হল তাঁদের নিঃসন্তান জীবন। এমনকী, পালিতা কন্যা নন্দিনী (পুপে)-র আগমনও অন্তর্গত ফাটলটি তেমন করে জুড়তে পারল না। দু’জনে দু’ভাবে মুক্তির সন্ধান করলেন হয়তো। ঝড় এল, যেমন আসে। চলেও যায়।
প্রয়াণের আগের বছর, ১৯৬০-এ ‘ভাই প্রতিমা’ সম্বোধন করে একটি চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি।’
অনুমান করা চলে, আজ, ২৭ নভেম্বর রথীন্দ্রনাথের জন্মদিনে কোনও অ-লৌকিকে তাঁদের দেখা হল হয়তো! রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, তেমন কোনও স্থানে। রবীন্দ্রনাথ ‘নৌকাডুবি’-তে ঝড়ের পরে চরাচরের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, যেন বা আক্ষরিকই সে রকম: ‘কুহেলিকা কাটিয়া গেছে। বহুদূরব্যাপী মরুময় বালুভূমিকে নির্মল জ্যোৎস্না বিধবার শুভ্রবসনের মতো আচ্ছন্ন করিয়াছে। নদীতে নৌকা ছিল না, ঢেউ ছিল না, রোগযন্ত্রণার পরে মৃত্যু যেরূপ নির্বিকার শান্তি বিকীর্ণ করিয়া দেয়, সেইরূপ শান্তি জলে স্থলে স্তব্ধভাবে বিরাজ করিতেছে।’
সেই স্তব্ধতার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসে দাঁড়ালেন প্রতিমা দেবী। তাঁদের কি পুনরায় দেখা হল? হয়তো বা। হয়তো নির্মলচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর স্ত্রী মীরা।
আর, ওই যে মায়াকুমারীগণ গান ধরলেন, যদি আর কারে ভালবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস, তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো...
আমার পরান যাহা চায়....
|
সূত্র: আপনি তুমি রইলে দূরে, সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ,
নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং |
|
|
|
|
|