রঘুনাথপুরকে ঘিরে উন্নয়ন পর্ষদ (ডেভলপমেন্ট অথরিটি) গড়ার কাজ শুরু হল। রাজ্য মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়ার পরে প্রথম ধাপ হিসেবে পরিকল্পনা পর্ষদ গড়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। চলতি অক্টোবর মাসে পরিকল্পনা পর্ষদ (প্ল্যানিং অথরিটি) গঠনের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি দেবাশিস সেন। উন্নয়ন পর্ষদ গড়ার পথে এটাই প্রথম ধাপ।
পরিকল্পনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ। তিনি বলেন, “রঘুনাথপুর উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করার প্রথম ধাপ হিসেবে পরিকল্পনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে পর্ষদের একটি দফতর খুলে কাজও শুরু হয়েছে।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, পরিকল্পনা পর্ষদ গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পরে তার কাজও এগিয়েছে। রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতরের আধিকারিকদের একটি দল সম্প্রতি এলাকায় প্রাথমিক সমীক্ষা করে গেছেন। রঘুনাথপুর ১ ও ২ ব্লক এবং নিতুড়িয়া ব্লকের রায়বাঁধ পঞ্চায়েত ও রঘুনাথপুর পুরসভা এলাকা মিলিয়ে মোট ২১২টি মৌজাকে পর্ষদের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই এই ধরনের উন্নয়ন পর্ষদ কাজ করছে। যেমন আসানসোল-দুর্গাপুর, মেদিনীপুর-খড়্গপুর, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি, শ্রীনিকেতন-শান্তিকেতন বা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ। পিছিয়ে পড়া জেলা হিসাবে চিহ্নিত পুরুলিয়াতেও এই ধরনের উদ্যোগের পিছনে সরকারের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কাজ করছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে। জেলার ‘শিল্পকেন্দ্র’ হিসাবে পরিচিত রঘুনাথপুরে এই উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হলে কাজ করতে অনেক সুবিধা হবে বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা।
বস্তুত রঘুনাথপুরে শিল্পায়নের কাজকে আরও বেশি মসৃণ গতিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে উন্নয়ন পর্ষদ কার্যকর ভূমিকা নেবে বলে প্রশাসন সূত্রে দাবি করা হয়েছে। বিশেষ করে যে ভাবে শিল্পগোষ্ঠীগুলি এই মহকুমায় বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাতে এই ধরনের পর্ষদ থাকা জরুরি। বর্তমানে রঘুনাথপুর ১ ও ২ ব্লকে জয় বালাজী শিল্প গোষ্ঠী ও শ্যাম স্টিলের প্রকল্পকে ঘিরে পরিকল্পিতভাবে শিল্প ‘হাব’ গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণ ছাড়া বাকি কারখানাগুলি নির্মিত হচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফলে এ ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত সমস্যায় পড়েছে শিল্পগোষ্ঠীগুলি।
রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির কথায়, “শিল্পায়ন করতে হয় পরিকল্পনামাফিক। উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা হলে শিল্পায়ন-সহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে জমির মানচিত্র অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক করা সম্ভব।” রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক আবিদ হোসেন বলেন, “এলাকায় জমির ব্যবহারের মানচিত্র তৈরি করা হচ্ছে পরিকল্পনা পর্ষদ গঠনের জন্যই। কোন এলাকায় শিল্প হবে, কোথায় পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, কোন এলাকায় স্কুল, কলেজ, আবাসন হবে তার পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট মানচিত্র তৈরি করবে পরিকল্পনা পর্ষদ।”
রঘুনাথপুরের পরিকাঠামো ও সরকারি পরিষেবার দিকগুলিও ঢেলে সাজতে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। মহকুমাশাসক জানান, পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক সম্প্রসারণের প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠিয়েছে পূর্ত দফতর। এ ছাড়াও মহকুমা কৃষি আধিকারিকের কার্যালয়, সহকারী শ্রম মহাধ্যক্ষের কার্যালয়ের মতো ৫-৬টি দফতরকে মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের মধ্যে নিয়ে এসে ‘এক জানলা’ পরিষেবা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জেলায় এসে রাজ্য পরিবহণ দফতরের সচিব ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকা জানিয়েছেন, রঘুনাথপুরে আঞ্চলিক পরিবহণ দফতরের কার্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। শুধু শিল্পায়নেই নয়, রঘুনাথপুরে সরকারি পরিষেবা ও পরিকাঠামো গঠনেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে রঘুনাথপুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। রঘুনাথপুর মহকুমায় ইতিমধ্যেই শিল্পস্থাপন করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। রঘুনাথপুর ২ ও নিতুড়িয়া ব্লকের একাংশ নিয়ে মেগা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ছে ডিভিসি। এই প্রকল্পের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডি পঞ্চায়েত এলাকায় ইস্পাত, সিমেন্ট ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ছে জয় বালাজি শিল্প গোষ্ঠী। ওই ব্লকেই ইস্পাত প্রকল্প গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে শ্যাম স্টিল। এ ছাড়া রঘুনাথপুর ২ ব্লকে ইস্পাত, সিমেন্ট প্রকল্প তৈরির করার কথা আধুনিক গোষ্ঠীর। তার পাশেই বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে চলেছে সৃষ্টি পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড। সব মিলিয়ে রঘুনাথপুর ১, ২ ব্লক ও নিতুড়িয়ায় শিল্পায়নের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে।
এই অঞ্চলে শিল্পায়নের পক্রিয়া শুরু হওয়ার সময়েই দাবি উঠেছিল আসানসোল-দুর্গাপুর, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের ধাঁচে এই এলাকাতেও উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা হোক। বিগত সরকার রঘুনাথপুর ১ ব্লকে শিল্প ‘হাব’ গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও উন্নয়ন পর্ষদ গঠনের কথা ঘোষণা করেনি। রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে বাসিন্দাদের দাবি মেনে উন্নয়ন পর্ষদ গড়ার প্রথম ধাপ হিসেবে পরিকল্পনা পর্ষদ গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি করল। বিধায়ক পূর্ণচন্দ্রবাবু বলেন, “পরিকল্পিত শিল্পায়নের পাশাপাশি উন্নত পরিকাঠামো গঠন বা স্কুল, কলেজ, আবাসন, বড় বাজার তৈরির জন্য উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। রঘুনাথপুর সম্ভাবনাময় এলাকা হওয়াতেই এই পর্ষদ গঠন করার অনুরোধ মুখ্যমন্ত্রীকে করা হয়েছিল।”
আপাতত গঠিত হয়েছে পরিকল্পনা পর্ষদ। পরের ধাপে উন্নয়ন পর্ষদের হাত ধরে শিল্পায়ন ও উন্নয়ন এলাকায় কতটা দ্রুতি পাবে, তা অবশ্য সময়ই বলবে। |