|
|
|
|
স্টেশনে ‘ট্যাক্সি-রাজ’ |
শিয়ালদহে, কলকাতায় ভাড়ার জুলুমটাই ‘নিয়ম’ |
আর্যভট্ট খান |
শুক্রবার সকাল ৬টা ৫০। শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকেছে দার্জিলিং মেল। স্টেশনের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে বেশির ভাগ যাত্রীই যেন চক্রব্যূহের মধ্যে পড়লেন। ট্যাক্সিচালকদের চক্রব্যূহ। মিটার নয়, সব চালকই যাত্রী নিতে চান চুক্তির ভিত্তিতে। ধর্মতলা ৮০ টাকা। বালিগঞ্জ ১৮০ টাকা। বাগুইআটি ২০০ টাকা। একটু দরদাম করলেই শর্ত চাপছে। সামনের আসনে অন্য যাত্রী নেবেন ট্যাক্সিচালক। মিটারে যেতে যদিও বা কেউ রাজি হন, তখন আবার নতুন শর্ত। মিটারে যা উঠবে, তার থেকে ৪০ টাকা বেশি লাগবে। ট্যাক্সিচালকদের দৌরাত্ম্য নিয়ে অভিযোগের জন্য পুলিশের কিয়স্ক আছে স্টেশন চত্বরে। তবে তালাবন্ধ।
বিকেল ৩টে ১০। কলকাতা স্টেশনে গোরক্ষপুর এক্সপ্রেস ঢুকেছে প্রায় আধ ঘণ্টা আগে। কিন্তু যাত্রীদের অধিকাংশ তখনও স্টেশন চত্বর থেকে বেরোতে পারেননি। পারবেন কী করে? ট্যাক্সি ভাড়া করতেই যে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তাঁদের! এখানে ট্যাক্সিচালকেরা আরও বেপরোয়া। কারণ তাঁরা জানেন, কার্যত আর কোনও যানবাহনই নেই অপেক্ষাকৃত নির্জন কলকাতা স্টেশনে। তাই ট্যাক্সিই ভরসা অধিকাংশ যাত্রীর। সুতরাং মিটার নয়, চুক্তি ছাড়া তাঁরা যাবেন না। কলকাতা স্টেশনের কাছে উল্টোডাঙা পর্যন্ত যেতেই চালক দর হাঁকছেন ৮০ টাকা। গড়িয়াহাট যেন ভিন্ গ্রহের দেশ। ভাড়া ৩৫০ টাকা। যে সব যাত্রী এ ভাবে যেতে রাজি নন, তাঁদের ভবিতব্য হেঁটে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ মোড় পর্যন্ত যাওয়া। স্টেশন চত্বরে গুটিকয়েক অটো আছে অবশ্য। কিন্তু তারাও তখন ‘সুযোগের সদ্ব্যবহারে’ ব্যস্ত।
|
|
শিয়ালদহ স্টেশনে চার দিকে ট্যাক্সির সারি, তবু মালপত্র নিয়ে নাজেহাল অপেক্ষা। |
শিয়ালদহ বা কলকাতা স্টেশন ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীদের হয়রানির এই ছবিটা নিত্যদিনের। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, বারবার অভিযোগ জানিয়েও কার্যত কিছুই বদলায়নি। শিয়ালদহ স্টেশনে যেমন প্রিপেড বুথ অধিকাংশ সময়েই কোনও কাজে আসে না বলে অভিযোগ। কারণ শিয়ালদহে অধিকাংশ দূরপাল্লার ট্রেন, যেমন উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস, দার্জিলিং মেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলি ঢোকে ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটার মধ্যে। এই সময়েই বন্ধ থাকে প্রিপেড বুথের কাউন্টার। বুথ খোলে আটটার পরে। ভোরে প্রিপেড কাউন্টারের সামনে একটা লাইন থাকে ঠিকই, কিন্তু প্রিপেড ট্যাক্সির স্লিপ মেলে না। কারণ ট্যাক্সিচালকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, স্লিপ ফুরিয়ে গিয়েছে।
শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা দিব্যেন্দু রায়। তাঁর অভিযোগ, “শিয়ালদহে ট্যাক্সির আসলে কোনও লাইনই নেই। পুরোটাই অরাজকতা। যে যেমন পারছে, ভাড়া হাঁকছে।” অভিযোগ, ট্যাক্সিচালকদের ‘সমঝোতা’ রয়েছে পুলিশের সঙ্গে। তাদের ১০ টাকা দিলেই যেখানে খুশি ট্যাক্সির লাইন দেওয়ার ‘অধিকার’ পেয়ে যান চালকেরা। যে যাঁর মতো লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পুলিশের দেখা মেলে না। শিয়ালদহের রেল-পুলিশ সুপার তাপসরঞ্জন ঘোষ অবশ্য বলেন, “টাকা নিয়ে পুলিশ ট্যাক্সিচালকদের সুবিধা করে দেয়, এই অভিযোগ ঠিক নয়। যাত্রীদের দেখভালের জন্য রেল-পুলিশ সব সময়েই স্টেশন চত্বরে থাকে। যে হেতু ভোরের দিকেই বেশি ট্রেন ঢোকে, তাই আমরা ওই সময়েই বেশি পুলিশ মোতায়েন করি। তবে স্টেশন চত্বরের বাইরে কোনও জুলুমবাজি হলে তার দায়িত্ব আমাদের নয়।” তবে, তাপসবাবুর বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি যে বেশির ভাগ সময়েই মেলে না, স্টেশন চত্বরে একটু ঘুরলেই তা বোঝা যায়। |
|
কলকাতা স্টেশনে যাত্রী ‘ধরার’ অপেক্ষায় ট্যাক্সিচালকেরা। |
কেন এই অরাজকতা? শিয়ালদহের প্রিপেড ট্যাক্সি বুথটি পরিচালনা করে কলকাতা ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। সিটুর অধীন ওই ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নীহার ঘোষ বলেন, ‘‘প্রিপেড লাইনে আগে এমনটা অন্তত ছিল না। এখন এই অরাজকতা বেড়েছে। তৃণমূলের একটা দল আমাদের বুথের দখল নিয়ে জুলুমবাজি চালাচ্ছে। ওরাই বেশির ভাগ সময়ে টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে ট্যাক্সি ঢোকাচ্ছে।” তাঁর দাবি, “বাইরের ট্যাক্সিগুলো মিটারে যেতে উৎসাহী নয়। ওরা মাসে একশো টাকা করে দেয় তৃণমূলের সংগঠনকে।” একশো টাকা পেলেই ওই সব ট্যাক্সি স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার পেয়ে যায় বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, বহিরাগত এই ট্যাক্সির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যদিও এই ধরনের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূলের ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেনস্ অ্যাসোসিয়েশন’। ওই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মদন মিত্র বলেন, “তৃণমূলের নামে বা তৃণমূলের ঝাণ্ডা নিয়ে এই ধরনের জুলুমবাজি করছে কিছু দুষ্কৃতী। শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন থেকে এই ধরনের ১০ জন দুষ্কৃতীকে চিহ্নিত করে আমরা তাদের বহিষ্কার করেছি। তৃণমূলের নাম করে ট্যাক্সিচালকদের কোনও জুলুমবাজি সহ্য করা হবে না। কোনও ধরনের জুলুম হলেই আমাদের জানান।”
শিয়ালদহ স্টেশন জনবহুল জায়গায় হওয়ায় হয়রানির শিকার হলেও যাত্রীরা কোনও না কোনও বিকল্প যানবাহন পেয়ে যান। কিন্তু কলকাতা স্টেশন চত্বরে ট্যাক্সি বাদে থাকে হাতে গোনা কিছু বাস ও অটো। ফলে মালপত্র থাকলে ট্যাক্সিই ভরসা বেশির ভাগ যাত্রীর। শুধু দিনে নয়, কলকাতা স্টেশনে বেশ কয়েকটি ট্রেন আসে রাতেও। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, দিনের বেলার ভাড়ার জুলুম রাতে একেবারে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এক নিত্যযাত্রী দেবজ্যোতি বসু বলেন, “এই স্টেশনে ট্রেনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এখনও কেন কোনও প্রিপেড বুথ তৈরি হল না?”
কলকাতা স্টেশন চত্বরে এখনও ঝুলছে একটা বহু পুরনো প্রিপেড ট্যাক্সির ভাড়া-তালিকা। বলাই বাহুল্য, কোনও ট্যাক্সিচালকই তা মানেন না। সঠিক পরিকাঠামো নিয়ে প্রিপেড বুথ তৈরি হলে যাত্রী হয়রানি অনেকটা কমবে বলে কার্যত স্বীকার করে নেন রেল পুলিশ সুপার। তিনি বলেন, “প্রিপেড বুথ গড়ার বিষয়ে আমরা রেলের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। শীঘ্রই ওই বুথ তৈরি হয়ে যাবে।” প্রায় একই বক্তব্য প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেনস্ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মদন মিত্রের। তিনি বলেন, “আমরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রেল বোর্ডের পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি। কলকাতা স্টেশনে ট্যাক্সির জুলুম বন্ধ করতে প্রিপেড বুথ দ্রুত তৈরি হওয়া প্রয়োজন।” |
ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ |
|
|
|
|
|