আঁতুড়ঘর থেকে ওয়াংখেড়ে, সর্বত্রই দুশ্চিন্তার বদলে আকুতি
কালের ওয়াংখেড়ে।
তিনি সচিন তেন্ডুলকর মাঠ থেকে প্র্যাক্টিস সেরে বেরোচ্ছেন। মুহূর্তে ভিড় তৈরি হয়ে গেল। কারও হাতে ক্যামেরা। কারও হাতে অটোগ্রাফের খাতা। নিরাপত্তারক্ষীদের বারণ কেউ শুনতে রাজি নয়। নিরানব্বই সেঞ্চুরির মালিকের নীরব সম্মতিতে আব্দারের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ছবি তোলা আর অটোগ্রাফ নেওয়ার ওই ঠেলাঠেলির মধ্যে কেউ কেউ অদৃশ্য নোটবুক আর পেন এগিয়ে দিয়েছে শততম সেঞ্চুরির স্বাক্ষরটা ওয়াংখেড়েতেই করে ফেলুন প্লিজ!
একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার এক কর্তা। তিনি তখন শোনাচ্ছেন, শততম সেঞ্চুরিটা এখানে হয়ে গেলে তাঁদের কী প্ল্যান। একশো স্বর্ণ মুদ্রা উপহার দেব। মুম্বইয়ের সমস্ত প্রাক্তন ভারত এবং রাজ্য অধিনায়ককে ডাকব। আমাদের প্রেসিডেন্ট বিলাস রাও দেশমুখ সন্ধ্যায় মিটিংয়ে বসছেন সবাইকে নিয়ে। আজই চূড়ান্ত নকশাটা করে ফেলা হবে।
দুপুরে ক্রিকেট সেন্টারে নিজের চেম্বারে বসে থাকা বোর্ডের প্রশাসনিক প্রধান রত্নাকর শেঠি।
সামান্য চিন্তিত। মাঠ ভরবে না ধরেই নিচ্ছেন। তবু দৈনিক টিকিটের দাম একশো টাকায় নামিয়ে এনে একটা শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। মোটামুটি পঁয়ত্রিশ হাজার দর্শক ধরে নতুন করে বানানো ওয়াংখেড়েতে। শেঠিরা মনে করছেন, মেরেকেটে আর্ধেকটা ভরতে পারে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ফাঁকা ইডেন দেখে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, শেঠি ঠিক সেটাই বলে ফেললেন, “ইংল্যান্ডের মতো আমাদের এখানেও উইক-এন্ডে টেস্ট করতে হবে। বৃহস্পতিবারে শুরু। রবিবার থার্ড ডে। টেস্ট জমে গেলে তো সোম, মঙ্গলবারে এমনিতেই ভিড় হবে।” সচিন যেমন মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে, সারা দেশ যেমন অধীর আগ্রহে সেই মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে, তেমনই ওয়াংখেড়ের সামনেও তো জোড়া কোহিনূর জেতার বিরল সুযোগ। একই বছরে বিশ্বকাপ জয় আর সচিনের শততম সেঞ্চুরির পীঠস্থান হয়ে থাকা।
ওয়াংখেড়েতেই কি প্রত্যাশার জাল ছিঁড়ে মুক্তি এনে দেবে ব্যাট? সোমবার প্র্যাক্টিসে সচিন। ছবি: উৎপল সরকার।
বলামাত্র শেঠি নড়েচড়ে বসলেন, “হয়ে গেলে সত্যিই দারুণ ব্যাপার। নাতি-নাতনিদেরও গল্প শোনাতে পারব।”
বিকেলের শিবাজী পার্ক। বছর ছাব্বিশ আগে এখান থেকেই মহাযাত্রা শুরু ঝাঁকড়া চুলের বিস্ময় বালকের। স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে বিশ্বরেকর্ড দিয়ে যাঁর প্রচারের আলোয় ঠিকরে বেরনো। কাম্বলি বহু কাল হল টিভি শো আর চ্যানেলে নাট্যরস আমদানি করছেন। তিনিসচিন তেন্ডুলকর এখনও ক্রিকেট রসে ডুবে রয়েছেন। এ দিন ভিভিএস লক্ষ্মণ বলছিলেন, “ম্যাচের আগে সচিন নিজেকে যে ভাবে তৈরি করে সেটাই প্রমাণ করে ও কেন এত সফল। ক্রিকেটজীবনের প্রথম দিন থেকে এটা করে আসছে। আজ শুধু শততম সেঞ্চুরির মতো একটা মাইলস্টোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে নয়। যে কোনও টেস্ট ম্যাচেই আমি দেখি সচিন একই রকম সিরিয়াস। প্রত্যেকটা নেট সেশনে একই রকম ফোকাস্ড। এত বছর ধরে ম্যাচ উইনার থেকে যাওয়াটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!”
প্র্যাক্টিসে না আসায় ধোনিকে নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। লক্ষ্মণকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, “আমি জানি না। ফিজিও বলতে পারবে।” পরে জানা গেল, শরীর ঠিক না লাগায় আসেননি ভারত অধিনায়ক। হাল্কা সর্দি-জ্বর হয়েছে। তবে না খেলার আতঙ্ক রাত পর্যন্ত নেই। থাকলে বদলি উইকেটকিপার উড়িয়ে আনতে হত। ও দিকে চন্দ্রপলের খেলা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। ভারতীয় প্রথম একাদশে ধরে নেওয়া যায় একটাই পরিবর্তন হচ্ছে। বাদ পড়া যুবরাজের জায়গায় বিরাট কোহলি। ইডেন টেস্ট জেতার পর গত পরশু যখন টিমের বেশির ভাগ সদস্য বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছেন, তখন দু’জন ক্রিকেটার মুম্বইয়ের বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সে ঢুকে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করছিলেন। তার এক জন বিরাট কোহলি। ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে যত কথাই উঠুক, ক্রিকেট-নিষ্ঠা নিয়ে সংশয় নেই।
অন্য লোকটা?
সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। শিবাজি পার্কে যাঁর জন্য যাওয়া। আজও একই রকম। গায়ে-গায়ে আজও অনেকগুলো নেট চলছে। শয়ে শয়ে মগ্ন কিশোরের ভিড়ে ক্রিকেট রসায়নাগারের ছবি। ঝাঁকড়া চুলের সচিনকে এই ক্রিকেট পার্কেই স্কুটারে বসিয়ে ঘোরাতেন রমাকান্ত আচরেকর। এই পিচে তুমি তাড়াতাড়ি আউট হয়ে গেলে মানে নিস্তার নেই। স্কুটারে উঠিয়ে অন্য পিচে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিতেন। এখানে ব্যাট করো।
ভেতরে ঢুকে কাম্বলির মতোই আর এক জনকে আবিষ্কার করা গেল। প্রবীণ আমরে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুণ ঝলমলে শুরুর পরেও কবে তলিয়ে গিয়েছেন। এখন কোচিং করান। পাশে বসা পদ্মাকর শিভালকর। ভারতীয় ক্রিকেটের সেই ট্র্যাজিক স্পিনার। সচিন যখন শিবাজি পার্কে তাঁর ক্রিকেট-সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, তখনও শিভালকর নিয়মিত ক্লাব ক্রিকেট খেলছেন। সেখানেই একটা ম্যাচে প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রথম আবিষ্কার করেন তেন্ডুলকরের প্রতিভা। এ দিন দেখা হতেই বলে উঠলেন, “সচিনের হান্ড্রেড্থ সেঞ্চুরি নিয়ে আমরা কেউ দুশ্চিন্তায় নেই। যে কোনও দিন করে ফেলবে। এখানেই করে ফেলতে পারে।” পাশে বসা আমরে যোগ করলেন, “যে লোকটা নিরানব্বই সেঞ্চুরি করেছে, তার কাছে আর একটা কী এমন ব্যাপার।” শিভালকর এর পর জিজ্ঞেস করলেন, “সচিনের প্রথম সেঞ্চুরিটা কোথায় ছিল যেন? আমি মনে করতে পারছি না।” বলা গেল, নব্বইয়ের অগস্টে। ম্যাঞ্চেস্টার। ১১৯ নট আউট। সচিনের সেঞ্চুরিতে ম্যাচ বাঁচায় ভারত। শুরু হয়ে গেল নানা স্মৃতিচারণ।
শিবাজি পার্ক থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকের গলিতে রমাকান্ত আচরেকরের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, দ্রোণাচার্য শুয়ে আছেন। শরীর ভাল নেই। কথা বলতে পারেন না। সচিন নিয়ে কোনও মন্তব্য পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দু’টো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। এক) সচিন বিশ্বকাপ জিতে দেখা করতে এসেছিলেন। নতুন বাড়িতে যাওয়ার আগে এসেছিলেন স্যরকে নেমন্তন্ন করতে। নতুন বাড়িতে নিয়েও গিয়েছিলেন জোরজার করে। দুই) টিভি এখনও দেখেন তিনি। ছাত্র শততম সেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন আর গুরুদেব দেখতে পেলেন না, এমন হয়তো হবে না।
অন্ধকার নেমে আসা গলি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এক ঝলক পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে হল, সত্যিই অসুস্থ ক্রিকেট-গুরুর বাড়ি থেকে ফিরছি? নাকি অধীর অপেক্ষা নিয়ে শরশয্যায় শায়িত ক্রিকেট-ভীষ্ম? প্রিয় শিষ্য কখন শততম সেঞ্চুরির জল নিয়ে পায়ের কাছে এসে দাঁড়াবে!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.