মেট্রো-চ্যানেল তাঁর মঞ্চে এনেছিল বিশিষ্টজনদের।
মেট্রো-চ্যানেলই তাঁর সঙ্গে তৈরি করল সেই বিশিষ্টদের একাংশের ‘সংঘাত’!
সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে মেট্রো-চ্যানেলে টানা ২৬ দিনের অনশন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের বড় একটি অংশকে। সেই মেট্রো-চ্যানেলে একটি সভার অনুমতি প্রত্যাহারকে নিয়ে সেই বিশিষ্টদেরই একাংশ কার্যত ‘সম্মুখ সমরে’ নেমে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
যাতে চাপা পড়ে গেল সভা করতে চাওয়া মানবাধিকার সংগঠনের দাবিগুলি। যে দাবিগুলির কয়েকটির সঙ্গে বিশিষ্টদের একাংশ ‘ভিন্নমত’ ছিলেন। চাপা পড়ে গেল কলকাতা পুলিশের এই ব্যাখ্যাও যে, মেট্রো চ্যানেলে যে দিনে সভা করার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল, সেই দিনে অন্য একটি সংগঠন সভা করার জন্য আগেই দরখাস্ত করে রেখেছে। পিছনে চলে গেল এটাও যে, সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে শহরের অন্য তিনটি ‘বিকল্প’ জায়গায় সভা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনাচক্রে, মমতা নিজে মেট্রো-চ্যানেলে সভা-সমাবেশ বন্ধ করতেই উদ্যোগী হয়েছেন। এমনকী, ১২ ডিসেম্বর তাঁর দলের যুব সংগঠনকেও তিনি সেখানে সভা করার অনুমতি দেননি।
কিন্তু সে সব ছাপিয়ে যা বড় হয়ে উঠল মুখ্যমন্ত্রী বনাম তাঁর নতুন সরকারের ‘শুভার্থীদের’ সংঘাত। যাঁদের পুরোভাগে
রইলেন মহাশ্বেতা দেবী। গত একুশে জুলাই তৃণমূলের শহিদ সমাবেশে যাঁকে হুইলচেয়ারে করে মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং মমতা।
যিনি সে দিন বলেছিলেন, “পরিবর্তন এসেছে মমতার জন্যই। আমরা কেউ কিছু নয়”, তিনিই এ দিন প্রশ্ন তুললেন, “আমরা কি ফ্যাসিজ্ম ফিরিয়ে আনছি?”
কলকাতা প্রেস ক্লাবে মহাশ্বেতা দেবীর ওই বক্তব্যের কিছু ক্ষণ পরেই মহাকরণে তার জবাব দেন স্বয়ং মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “ওঁর বয়সকে সম্মান করি বলে কিছু বলছি না। কিন্তু এটাকে ভাল চোখেও দেখছি না। মহাশ্বেতা দেবী যা বলেছেন, তা তাঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে। আমি লক্ষ করলাম, পাশে এসে এসে তাঁকে বলে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য উনি নিজেও তা বলতে পারেন। আমার দুঃখ হয়েছে। উনি তিন বার অসুস্থ হয়েছেন। আমি গিয়ে দেখে এসেছি। বঙ্গবিভূষণ খেতাব দিয়েছি। আমাদের কমিটিতে উনি রয়েছেন।” এর সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, “তার পরেও আমায় ফ্যাসিস্ত বলার জন্য আমি কৃতজ্ঞ!” |
|
|
মহাশ্বেতা দেবী |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
তবে মমতাকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলা নিয়ে আবার বিশিষ্টদের মধ্যেই মতদ্বৈত দেখা দিয়েছে। নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী (যিনি এপিডিআরের এসএমএসের জবাবে এসএমএস করে জানিয়েছিলেন, তিনি ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধাসৃষ্টির প্রতিবাদ’ করছেন) যেমন সরাসরিই বলেছেন, “মমতাকে ফ্যাসিস্ত বলা বাতুলতা! সেটা যিনিই বলুন না কেন! যিনি বা যাঁরা বলছেন, তাঁরা ফ্যাসিজিম দেখেননি।” অভিনেতা কৌশিক সেনও মমতাকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলার বিরোধী। তাঁর কথায়, “নানা রকমের গোলযোগ ও প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও এখনই এই সরকারকে ফ্যাসিস্ত বলতে রাজি নই।” বস্তুত, কৌশিক মনে করেন, জঙ্গলমহল থেকে যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের ‘সময়’ এখনও আসেনি। এপিডিআরের দাবি সমর্থন না-করলেও অপর্ণা সেন বাক্-স্বাধীনতার উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারির ‘তীব্র প্রতিবাদ’ জানিয়েছেন। তবে ‘ফ্যাসিস্ত’ প্রসঙ্গে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। রাতে ওই বিষয়ে প্রশ্ন করলে অপর্ণা বলেন, “যা বলার আগে বলেছি। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।”
‘ফ্যাসিস্ত’ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম কোনও মন্তব্য করেনি (তারা অবশ্য মমতাকে বরাবরই ‘আধা-ফ্যাসিস্ত’ বলে থাকে)। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “যা হয়েছে, সেটা মূলত ঘরোয়া কোন্দল। এ ব্যাপারে আমরা খুব বেশি উৎসাহী নই। যাঁরা ওঁর (মমতা) সঙ্গে ছিলেন, ওঁদের হয়ে প্রচার করেছিলেন, উনি যাঁদের নিয়ে সভা-মিছিল করেছিলেন, হয়তো তাঁরা আজ চার ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা তো ঘরোয়াই! কংগ্রেস, বিশিষ্টজন সবই! তাঁকেই সামলাতে হবে। আমরা কী বলব?” তবে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ বিবৃতি দিয়ে সরাসরি বলেছেন, ‘‘এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে!”
ঘটনার সূত্রপাত আপাত-নিরীহ একটি সভাকে কেন্দ্র করে। জঙ্গলমহল থেকে যৌথবাহিনী প্রত্যাহার, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি-সহ বিভিন্ন দাবিতে আগামী ২৩ ও ২৪ নভেম্বর অনশন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)-সহ ২১টি সংগঠন। এপিডিআরের পক্ষে তাপস চক্রবর্তী জানান, গত ৪ তারিখ কলকাতা পুলিশ তাঁদের ওই কর্মসূচি করার অনুমতি দিলেও পরে চিঠি পাঠিয়ে তা প্রত্যাহার করতে বলে। তাঁর কথায়, “প্রশাসনের তরফে ওই চিঠিতে কার্যত বলা হয়, আমাদের কর্মসূচি বাতিল করতে।”
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম অবশ্য বলেন, “মেট্রো-চ্যানেলের বদলে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, কলেজ স্কোয়ার, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট-আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড়ের মতো যে কোনও একটি জায়গায় সমাবেশ করার জন্য ওঁদের অনুরোধ করা হয়েছিল। ওঁরা জানান, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট-আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড়ে ওই দু’দিন অবস্থান-সমাবেশ করতে রাজি। সেই মতো অনুমতি চেয়ে গত ১৭ নভেম্বর চিঠিও জমা দেন মুচিপাড়া থানায়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই জায়গায় পুলিশি ব্যবস্থাও চূড়ান্ত করা হয়।”
লালবাজার সূত্রের খবর, ২৩ থেকে ২৫ নভেম্বর মেট্রো-চ্যানেলে কনভেনশন, ওয়ার্কশপ করার অনুমতি চেয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ লালবাজারে চিঠি জমা দেয় গত ২৮ অক্টোবর। এপিডিআর চিঠি দিয়েছিল ৫ নভেম্বর। একই জায়গায় দু’টি সংগঠন সমাবেশ করতে চাওয়ায় পরের দরখাস্তকারীকে অন্যত্র সরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়। সাধারণ ভাবে এটাই দস্তুর বলে পুলিশকর্তাদের দাবি।
এর পরেই ঘটনা দ্রুত গড়াতে থাকে। সোমবার ওই সমস্ত সংগঠনের তরফে সাংবাদিক বৈঠক ডাকা হয়। প্রথমে চিঠি পাঠিয়ে পরে সেখানে হাজির হন মহাশ্বেতা দেবী। ‘সমর্থন সূচক’ চিঠি পাঠান শঙ্খ ঘোষ, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, তৃণমূলের সাংসদ কবীর সুমন।
শঙ্খবাবু তাঁর চিঠিতে বলেছেন, ‘এই তথ্য জেনে বিমূঢ় বোধ করছি। নতুন সরকারের শুভার্থী হিসেবে আশা করব, এই নিষেধাজ্ঞা তাঁরা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেবেন’। প্রতূলবাবু লিখেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিপন্থী। এ কথা যে কোনও নির্বাচিত সরকারেরই মনে রাখা প্রয়োজন’। সুমনের চিঠি বলছে, ‘এই দেশ, এই রাজ্যের এক জন আয়করদাতা নাগরিক হিসেবে আমি এই সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানাচ্ছি’।
মমতার নাম না-করে মহাশ্বেতা দেবী বলেন, “যাঁরা সভা সরানোর কথা বলেছে, তারা ঠিক কাজ করেনি। আমি এর বিরোধিতা করছি। এটা অভাবনীয়। অসহনীয়।” মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁর ‘বার্তা’ জানিয়ে প্রবীণ লেখিকা বলেন, “সংবেদনশীলতা থাকলে ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।” তিনি কি এই ঘটনাকে ‘ফ্যাসিজম’ বলে মনে করেন? মহাশ্বেতা দেবীর উত্তর, “এটা ফ্যাসিজম ছাড়া
আর কিছুই নয়! যে কথা আমরা বিগত ৬৪ বছরে ভাবতে পারিনি, জনগণের সরকার এসে সেই কাজটি করলেন। অর্থাৎ মেট্রো-চ্যানেলে সমবেত হয়ে জনসাধারণ স্বীয় বক্তব্য বলার অধিকার হারালেন। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম।”
তবে পাশাপাশিই মহাশ্বেতা দেবী জানিয়েছেন, জঙ্গলমহলে মমতার উন্নয়নের কর্মসূচি তিনি ‘সমর্থন’ করেন। সেই কর্মসূচির ‘বিরোধিতা’ করেন না। যেমন ‘সমর্থন করেন না’ মাওবাদীদের হাতে সাধারণ মানুষ খুনের ঘটনা। তিনি যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের পক্ষে। তাঁর কথায়, “এটা মমতার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল।” যার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “প্রতিশ্রুতি মতোই বাহিনীকে পাঁচ মাস বসিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু শান্তি-প্রক্রিয়া চলাকালীন ওরা সাত-দশ জনকে খুন করেছে। সেই অধিকার তো দিতে পারি না!”
মমতা সরাসরিই এই বিশিষ্টদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ওঁরা মাওবাদীদের মুখোশ। ওঁরা যে দিন চাইবেন, সে দিন অনুমতি দিতে হবে? যা বলবেন, তাই শুনতে হবে? মাওবাদীদের দালালি করবেন? কলকাতার কিছু লোকের জন্য মাওবাদীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। মাওবাদী ছেড়ে অনেকে মূলস্রোতে ফিরে আসায় অনেকের গায়ে লাগছে! তা হলে তো আর ওদের নাম করে টাকা তোলা যাবে না!” ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “মাওবাদীরা বলছে, মমতার মুন্ডু চাই। মুকুল রায়, খাদ্যমন্ত্রীর মুন্ডু চাই। যারা ওদের বিরুদ্ধে, তাদের সকলেরই মুন্ডু ওদের চাই! মাওবাদীরা মুন্ডু চাওয়ার সময় কি এই দাদা-দিদিরা মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখেন? এই অপপ্রচার ও কুৎসাকে ধিক্কার জানাই। ওঁরা মাওবাদীদের গরিমা বাড়াচ্ছেন! কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই আইন করে মাওবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। চাইলে আমিও ওই আইনে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু আমি গণতন্ত্র মানি। ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নতুুন করে ভাবব।” এপিডিআরের কার্যকলাপ নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সামনে মাওবাদীদের মুখোশ পরে পিছনে নারী অধিকার, ছাত্র সংগঠনের নামে খুন-করা, লুঠ-করার কমিটি চলছে।”
এপিডিআরের তরফে এ দিন জানানো হয়, আজ, মঙ্গলবার তারা নব মহাকরণের সামনে প্রতিবাদ সভা করবে। ২৩ ও ২৪ তারিখ বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট-আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে দিনভর অনশনের পরে ২৫ তারিখ সেখান থেকে মহাকরণ অবধি মিছিল করা হবে। তাপসবাবু বলেন, “আমরা জানি, আমাদের মহাকরণ অবধি যেতে দেওয়া হবে না। যেখানে আটকানো হবে, সেখানে দাঁড়িয়ে পথসভা করব।”
কবীর সুমন দলের সাংসদ থাকলেও মমতার সঙ্গে তাঁর এখন যোজন-দূরত্ব। সুমন সম্পর্কে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে এ দিন মমতা বলেছেন, “উনি এখনও তৃণমূলের সাংসদ। এক সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওঁকে বরখাস্ত করতে পারি। কিন্তু তা করছি না। উনি ওঁর কাজ করছেন। গণতন্ত্রে কারও কণ্ঠরোধ করতে চাই না। উনি ছত্রধর-জাগরীকে নিয়ে গান বেঁধেছেন। এখন অবশ্য জাগরী ফিরে এসেছে। নতুন করে কী বলবেন, জানি না। আমি তো আগেই বলেছিলাম, ওঁকে দলে আনা আমার ভুল হয়েছে! ওঁরা শিল্পী মানুষ। উনি চরমপন্থী সমর্থক। দলবিরোধী কাজ করলে দল সিদ্ধান্ত নেবে।” |