এ রাজ্যে অপরাধ সংক্রান্ত বিচারের ক্ষেত্রে ‘করুণ’ দশায় খেদ প্রকাশ করলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেল। বিচারাধীন বন্দিদের অনশনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই মত জানিয়েছেন। শনিবার হাইকোর্টের নতুন ভবনের প্রেক্ষাগৃহে একটি অনুষ্ঠানে পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলিদের একযোগে সমালোচনাও করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি অবশ্য বন্দিদের আন্দোলন নিয়ে মন্তব্য করেননি। বরং সরকারি কৌঁসুলি ও পুলিশকর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মামলার ‘দীর্ঘসূত্রিতা’র কারণগুলি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। পুলিশি তদন্তের ‘ব্যর্থতা’য় কোনও কোনও দাগি দুষ্কৃতীর জামিন পেয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রধান বিচারপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “এ রাজ্যের অপরাধের বিচারের হাল করুণ। পুলিশ সাধারণত ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে পারে না। ফলে দুষ্কৃতীরা বিলক্ষণ বোঝে ৯০ দিন ধৈর্য ধরতে পারলেই জামিনে মুক্তি নিশ্চিত। বেআইনি কাজ প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ-এর ক্ষেত্রেও এমনই ঘটে থাকে। মাদক-কারবারি, শিশু ও নারী পাচারকারী বা দাগি লুঠেরারা ছাড়া পেলে প্রমাণ লোপাট করবে বা ফের কুকাজে জড়াবে, এটা মাথায় রাখা উচিত।”
ময়নাতদন্ত, ফরেন্সিক বা অস্ত্র পরীক্ষার (ব্যালিস্টিক) রিপোর্ট পেতে দেরির জন্য পুলিশকে অসহায় ভাবে ভুগতে হয় বলেও প্রধান বিচারপতির অভিমত। আবার ‘ন্যায় বিচারে’র স্বার্থে সাক্ষীর বয়ান হুবহু নথিভুক্ত করার জন্য তা ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ভাষাতেও লেখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আন্তরিকতা’র কথা মনে করিয়ে দেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাঁর কথায়, “নতুন মন্ত্রিসভা গড়ার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী বিচারবিভাগকে সহযোগিতার কথা বলছেন। সেইমতো রাজ্যে বিভিন্ন স্তরের নিম্ন আদালতে ১৫৩ জন বিচারকের শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে। হাইকোর্ট ছাড়া অন্য কোর্টে বিচারকের পদ খালি নেই। আর কোর্টের ১৭০০ জন কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।” আদালতে পর্যাপ্ত কর্মী থাকলে মামলার কাজ হবে সুষ্ঠু ভাবে এবং বিচারাধীন বন্দিদের ক্ষোভও কমবে বলে দাবি আইনমন্ত্রীর। এ দিন রাজ্যের জেলে জেলে অনশন-আন্দোলন থেকে পুরুলিয়ার বন্দিরা সরে এসেছেন বলে জানান মলয়বাবু। কারা দফতর সূত্রের খবর, মেদিনীপুরে ২২ জন বন্দি পালা করে অনশন করছেন। আলিপুর, প্রেসিডেন্সি ও দমদম মিলিয়ে এখনও ৩৫০-৪০০ জন অনশন চালাচ্ছেন।
বন্দিদের আন্দোলন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও হাইকোর্টে আইনজীবী-পুলিশের তালিমের আসরে ঘুরে-ফিরে এই প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে। বিচারপতি জয়মাল্য বাগচিও এ রাজ্যের জেলের ঘটনাবলি নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু এ দেশের বন্দিদের হাল নিয়ে তিনিও খেদোক্তি করেন। টু জি স্পেকট্রাম-কাণ্ডে কর্পোরেট-কর্তাদের ‘শ্রীঘর-বাস’ নিয়ে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী সলমন খুরশিদের একটি মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে জয়মাল্যবাবু বলেন, “ভিআইপি-বন্দিরা জেলে ঢুকলে দেশে লগ্নির হাল কী হবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দুশ্চিন্তা, কিন্তু গরিব মানুষ জেলে পচলে কারও মাথাব্যথা নেই।” এ রাজ্যে বিচারাধীন বন্দিদের পরিস্থিতির প্রসঙ্গেও এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইনজীবী-পুলিশকর্তাদের অনেকেই। রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বন্দিদের অনশন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “মামলা আটকে থাকার পিছনে বিচার-বিভাগের ভুল বোঝা, আইনজীবীদের টালবাহানা বা পুলিশি তদন্তে পরিকাঠামোর অভাবও দায়ী। অনেক সময়ে বিচারকও সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রভাবিত হন।” আইনজীবীদের ভূমিকা প্রসঙ্গেও প্রধান বিচারপতি এ দিন বলেন, “আইনজীবীদের কাজ সাক্ষীকে ব্যতিব্যস্ত করা নয়, বিচারককে সাহায্য করা।” |