মাওবাদীদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার বা ওই বাহিনীর অভিযান বন্ধের বিষয়ে তিনি কোনও নির্দিষ্ট আশ্বাস দেননি।
পূর্ব পরিকল্পনা মতোই শনিবার দুপুরে সুজাত ভদ্রের নেতৃত্বে ছ’জন মধ্যস্থতাকারী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এবং স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতমও ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ বৈঠক চলে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে সুজাতবাবু বলেন, “আমরা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে থাকতে চাইনি। সে কথা জানানোর পর মুখ্যমন্ত্রী আমাদের ডেকেছিলেন। আলোচনা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের উপর পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা যেন শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাই। মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলি। সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে।”
পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করতে রাতে সুজাতবাবুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। রাতে তাঁদের মধ্যে ছোটন দাস জানান, তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন।
মাওবাদীদের অস্ত্র সংবরণ চুক্তির অন্যতম ‘শর্ত’ ছিল জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ করা। সেইসঙ্গে তারা বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছিল। মাওবাদীদের সঙ্গে নতুন করে শান্তি আলোচনার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের উদ্যোগী হতে বললেও মুখ্যমন্ত্রী ওই বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি বলেই প্রশাসনিক সূত্রের খবর। বস্তুত, মমতা বারবার শান্তি প্রক্রিয়া চালু রাখার কথা বললেও এ-ও বলেছেন, মাওবাদীরা মানুষ খুন করলে প্রশাসন চুপ করে বসে থাকবে না। প্রশাসন সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের কাজ করবে। যে বিষয়ে সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো নেতা কার্তিক পাল এ দিন বলেছেন, “সরকার আসলে মধ্যস্থতাকারীদের শিখণ্ডী খাড়া করে আড়ালে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালাচ্ছে। মধ্যস্থতাকারীদের শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে বলা আসলে যৌথ বাহিনীর অভিযান ঢাকা দেওয়ার সরকারি কৌশল।”
মধ্যস্থতাকারীরা জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আলোচনা চালাতে বললে তাঁরাও পাল্টা বাহিনীর অভিযান বন্ধের ‘শর্ত’ দেবেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এ দিন সে কথা তাঁরা বলেওছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নীরবই থেকেছেন।
সে ক্ষেত্রে কি নতুন করে শান্তি আলোচনা করা সম্ভব? সুজাতবাবু বলেন, “আমরা রাজ্য সরকারের কথা মাওবাদীদের বলার চেষ্টা করব। যেমন আমরা মাওবাদীদের কথাও রাজ্য সরকারকে বলার চেষ্টা চালাচ্ছি। যদি মাওবাদীরা আমাদের সঙ্গে কথা বলার পর অস্ত্র সংবরণ বা শান্তিতে রাজি হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীকে তা জানাব। না-রাজি হলে বলব, আমরা পারলাম না!” সুজাতবাবুর দাবি, “পৃথিবীর সর্বত্র শান্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে। মধ্যস্থতাকারীদেরও দীর্ঘদিন ধরে এ ভাবেই দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হয়।”
মধ্যস্থতাকারী কমিটির সদস্য কল্যাণ রুদ্র এদিনও বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, তিনি নদী-বিশেষজ্ঞ। ফলে এই কমিটি থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, তাঁর মতো মানুষের কমিটিতে থাকা প্রয়োজন। কল্যাণবাবু পরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হয়েছে, তিনি শান্তি চান। সেই শান্তি প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকার এবং মাওবাদী উভয়কেই উদ্যোগী হতে হবে।” কমিটির অন্য সদস্য অশোকেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “আমরা যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দেননি। উনি আমাদের বলেন, আমরা সকলে মিলে যেন আরও এক বার মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলি। সরকার রাজ্যে শান্তি চায়। মাওবাদীদের যেন আমরা এই বার্তা দিই।” অশোকেন্দুবাবু আরও বলেন, “পরবর্তী বৈঠকে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত ভাবে জানাব। তার আগে মাওবাদীদের সঙ্গে এক দফা কথা বলে নিতে চাই।”
বৈঠকের শুরুতেই মধ্যস্থতাকারীরা মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, তাঁরা দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ চেয়ে মুখবন্ধ খামে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে কী করে সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হল? মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। এর পর সুজাতবাবু সহ মধ্যস্থতাকারীরা বলেন, সংবাদমাধ্যমে তাঁদের নামে নানা কথা প্রচারিত হচ্ছে। তাঁদের কাজকর্ম নিয়েও নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাঁদের সততা নিয়েও। তাতে তাঁরা সকলেই ‘ব্যথিত’। জবাবে মমতা তাঁদের ওই সব বিষয়ে কান না-দিতে বলেন। রাজ্যে তথা জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরাতে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। মধ্যস্থতাকারীদেরও সেই শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা যেন আবার মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলেন।
মধ্যস্থতাকারীদের একজন বৈঠকে বলেন, মাওবাদীরা তাদের কথা রেখে প্রায় এক মাস ‘হিংসাত্মক’ আচরণ করেনি। কিন্তু যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরুর প্রেক্ষিতে তারা আবার হিংসার পথে ফিরে গিয়েছে। যৌথ বাহিনী যেন এমন আচরণ না-করে, যাতে জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হন। সে বিষয়টাও রাজ্য সরকারকে দেখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দেন, ‘অকারণে’ কোথাও হানা দেওয়া হবে না। গুলিও চালানো হবে না। ‘প্রয়োজন পড়লে’ তবেই যৌথ বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। দু’পক্ষে দীর্ঘ আলোচনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে পুনরায় সুজাতবাবুরা মাওবাদীদের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মহাকরণের বৈঠক নিয়ে মাওবাদীদের তরফে সরাসরি কোনও ‘আনুষ্ঠানিক’ প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। তবে এক মাওবাদী নেতা বলেন, “এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটি নেবে। কিন্তু এক দিকে যৌথ বাহিনী অভিযান চালাবে, আমাদের কমরেডদের গুলি করে মারবে। অন্য দিকে শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য মধ্যস্থতাকারীরা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে এই দুটো বিষয় কি একসঙ্গে চলতে পারে?” তাঁর আরও বক্তব্য, “সুজাতবাবুরা আলোচনা করতে চাইলে হয়তো দল রাজি হবে। কিন্তু তাতে কোনও ফল হবে বলে মনে হয় না।” |