তিনি ‘ভাল মানুষ’। কিন্তু মুখে লাগাম নেই!
বিমান বসুকে নিয়ে তাই যুগপৎ ক্ষোভ ও বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে সিপিএমে। সঙ্গে বামফ্রন্টেও। আলটপকা মন্তব্য করে বিমানবাবু ‘দুঃখপ্রকাশ’ করছেন। পরে আবার একই কাজ করছেন! কিন্তু দল এবং বামফ্রন্টের ‘ক্ষুণ্ণ’ শীর্ষ নেতৃত্বও একটা পর্যায়ের পরে আর এগোতে পারছেন না। কারণ, বিমানবাবুর ‘ভাল মানুষে’র পরিচয়! কাজেই ‘ভাল মানুষে’র ‘শুভবুদ্ধি’র উপরে ভরসা করে থাকা ছাড়া উপায় নেই তাঁদের।
কিন্তু সেটাও শেষ ‘ভরসা’ নয়। অন্তত এই মুহূর্তে। দক্ষিণ কলকাতার মতো সিপিএমের বরাবরের ‘কঠিন’ লোকসভা কেন্দ্রে ভোট আসন্ন। একে ‘পরিবর্তনের’ বাজার। তার উপর বিমানবাবুর কিছু মন্তব্য তাঁদের ভোট-ভাগ্য ইতিমধ্যেই ঝরঝরে করে দিয়েছে বলে আশঙ্কায় দল ও ফ্রন্ট নেতৃত্বের একাংশ! দক্ষিণে প্রচারের দায়িত্বে থাকা সিপিএমের এক নেতা বললেন, “এ সব কথার পরে মহিলারা আর আমাদের ভোট দেবেন? কে বোঝাবে!”
বিমানবাবুকে অবশ্য ‘বোঝানো’ হয়েছে। কিন্তু বিড়ম্বনা, ‘বুঝেও’ বিমানবাবু ফের বিচিত্র মন্তব্য করে বসেছেন! ভোটবাজারে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা তো বটেই, সম্মেলনের মরসুমে সিপিএমের নিচু তলাতেও তার প্রতিক্রিয়া ভাল নয়। বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে এ বারের সম্মেলন-পর্বে বিস্তর কাটাছেঁড়া হচ্ছে। সেখানে উঠে আসছে শীর্ষ নেতাদের অসংযত মন্তব্য-জনিত বিপর্যয়ের কথাও। ভোটের ফলপ্রকাশের পর সিপিএমের রাজ্য কমিটির পর্যালোচনা রিপোর্টে নেতাদের একাংশের ‘বেসামাল’ মন্তব্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল, অনিল বসু বা রাজ্য স্তরে গৌতম দেবের কিছু বক্তব্যের কথা বলা হচ্ছে। এখন সম্মেলনে নিচু তলার কর্মীরা খোদ রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর নাম করেই সমালোচনা করছেন! বিরাটি লোকাল কমিটির সম্মেলনে তো প্রায় নজিরবিহীন ভাবে রাজ্য সম্পাদকের ‘শাড়ি’ সংক্রান্ত মন্তব্যের উপরে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ‘নভেম্বর বিপ্লবে’র মাসেই একের পর এক বিভ্রাট ঘটিয়েছেন বিমানবাবু। প্রথমে ট্রেড ইউনিয়নের আইন অমান্যের দিন রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে একটি বাসের সামনের দরজা দিয়ে উঠে পিছনের দরজা দিয়ে নেমে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছেন। পর দিনই ফ্রন্ট বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস-তৃণমূলের টানাপোড়েন নিয়ে ‘শাড়ি’ সংক্রান্ত এমন মন্তব্য করেছেন হাতের বিচিত্র মুদ্রা সহযোগে, যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। ‘চাপে’ পড়ে ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তার তিন দিনের মধ্যেই দিল্লিতে একটি প্রশ্নের জবাবে আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁটার অসুবিধা আছে’ বলে এমন কটাক্ষ করেছেন, যার ব্যাখ্যা স্বাভাবিক বুদ্ধিতে খুঁজে পাচ্ছেন না দলের নেতারা!
সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং বামফ্রন্টের রাজ্য নেতারা বিমানবাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন। ‘শাড়ি’ সংক্রান্ত মন্তব্যের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছেও বিমানবাবু অকপটে জানিয়েছেন, ‘সাদা মনে’ কথাটা বললেও শব্দ ব্যবহারের জন্য যা হয়েছে, তাতে তিনি ‘ব্যথিত’। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আর কথা বাড়াতে চাননি। তবে কেন্দ্র ও রাজ্য নেতৃত্ব, সকলকেই বিমানবাবু জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমের হাতে ‘উত্যক্ত’ হয়েই তাঁর কিছু ‘ভুল’ হয়ে গিয়েছিল! আইন অমান্যের দিনের ঘটনা নিয়ে ফ্রন্টের অন্দরে চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যায় নেতারা ‘চমকিত’! তিনি বলেছেন, সে দিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার তাড়নায় দ্রুত হাঁটতে গিয়ে তিনি পিছনের মিছিল দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাই বাসে উঠেছিলেন। আদতে দায়ী তাঁর উচ্চতার ঘাটতি! অহেতুক তাঁকে আক্রমণ করা হচ্ছে!
শুনে যথেষ্ট কৌতুক হয়েছে ফ্রন্ট নেতাদের। কিন্তু তার মধ্যেই তাঁদের ক্ষোভ, টেলিভিশনের বাজারে আজকাল যে আর ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ হয় না এই কথাটা বিমানবাবু কবে বুঝবেন? ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “এমন কথা বলারই কী দরকার, যার জন্য পরে দুঃখপ্রকাশ করতে হবে?” আরএসপি-র কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “অনেক বার ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। মানুষটা মন থেকে ভাল। একটা পর্যায়ের পরে আর কিছু তাই বলাও যায় না।” সিপিআইয়ের এক রাজ্য নেতার কথায়, “সংবাদমাধ্যমের সামনে উনি এলেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে! আবার কী করে বসবেন, কে জানে!”
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম-পর্বে বিনয় কোঙারের লাগাতার ‘বিতর্কিত’ মন্তব্যের জেরে এক সময় তাঁকে সংবাদমাধ্যমের থেকে আড়াল করে ফেলেছিল সিপিএম। প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতমবাবু বেশি কথা বলে বিপদ বাড়াচ্ছিলেন বলে তাঁকেও ‘সংযত’ হতে বলেছিল দল। কিন্তু বিমানবাবুর সেই সুযোগ নেই। তিনি দলের রাজ্য সম্পাদক, বামফ্রন্টেরও চেয়ারম্যান। মুখ তাঁকে খুলতেই হবে। তাই বিপদের আশঙ্কাও থাকবে! |