তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কে আরও ‘জটিলতা’ তৈরি হল। রাজ্য কংগ্রেস নেতারা যখন বিষয়টিকে ‘ক্লোজ্ড-চ্যাপ্টার’ বলে আপাতত ধামাচাপা দিতে চাইছেন, তখন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের মন্তব্যে ঘনিষ্ঠমহলে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার রাজ্যে এসেছিলেন জয়রাম। প্রত্যাশিত ভাবেই, তাঁর কাছে সাংবাদিকরা শুক্রবারের যুব কংগ্রেস মিছিল এবং তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জানতে চান। প্রথমে ওই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন না-করার অনুরোধ করলেও পশ্চিম মেদিনীপুর সফরের অবকাশে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী শিশির অধিকারীর সামনেই জয়রাম বলেন, “এ রাজ্য থেকে কংগ্রেস কি বনবাসে গিয়েছে? কংগ্রেস একটি রাজনৈতিক দল। তৃণমূলও একটি রাজনৈতিক দল। মিছিল করাটা যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই অধিকার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেস তো এখনও ভিআরএস নেয়নি!” এরই পাশাপাশি অবশ্য জয়রাম বলেন, “কংগ্রেস-তৃণমূল একই পরিবার। মমতাও তো কংগ্রেসেই ছিলেন। শিশিরবাবুও তো কংগ্রেসেই ছিলেন এক সময়।” কংগ্রেস-তৃণমূলের ‘সমন্বয়’ও যথেষ্ট ভাল বলে তিনি মন্তব্য করেন। জয়রামের কথায়, “একই পরিবারে থাকতে গেলে কখনও কখনও ঠোকাঠুকি লাগে। তাতে বড় কোনও সমস্যা হয় না।”
ঘটনাচক্রে, তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই জয়রামের তরফে আজ, রবিবার মমতার সঙ্গে দেখা করার জন্য ২০ মিনিট সময় চাওয়া হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, তিনি ‘ব্যস্ত’ থাকবেন। ফলে তাঁর পক্ষে সময় দেওয়া সম্ভব হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রের খবর, রবিবার তাঁর কোনও সরকারি কর্মসূচি নেই। তবে মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতা এ দিন বলেন, “সামনেই দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার উপ-নির্বাচন। নেত্রী সেই বিষয়ে সারা দিনই ব্যস্ত থাকবেন। তা ছাড়া, জয়রামের সঙ্গে তো তাঁর কিছু দিন আগেও কথা হয়েছে!”
ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রাতে শিশিরবাবু দাবি করেন, জয়রাম কোনও ‘অভিপ্রায়’ নিয়ে ওই মন্তব্য করেননি। তাঁর দাবি, “উনি মিছিল প্রসঙ্গে ওই কথা আদৌ বলেননি। যা বলেছেন, তা-ও হাল্কা চালে।”
এই ঘটনাপ্রবাহে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভেঙে যাবে, এমন সম্ভাবনা কোনও শিবিরই দেখছে না। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল গড়া, মমতার উপর হামলায় অভিযুক্ত মোক্তারকে কংগ্রেসে নেওয়া, কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত রাম পেয়ারি রাম-খালেক মোল্লাকে তৃণমূলে নেওয়া, বগুলায় পুলিশের গুলিতে কংগ্রেসের মহিলা কর্মীর মৃত্যু নিয়ে দুই শরিকের ‘টানাপোড়েন’ চলছে। এরই মধ্যে কংগ্রেস কর্মীরা তাঁদের কর্মীদের উপর ‘হামলা’ করছে অভিযোগ এনে সম্প্রতি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যকে চিঠি দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। কংগ্রেসের তরফে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। তার মধ্যেই শুক্রবার ঘটে যায় হাজরা থেকে ময়দানে গাঁধীমূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত যুব কংগ্রেসের মিছিল। ওই মিছিলে ছিলেন রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সিও। কংগ্রেসের বিভিন্ন ‘কাজকর্মে’ মমতা এমনিতেই ‘ক্ষুব্ধ’ ছিলেন। শুক্রবারের মিছিলের পরেই তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “কংগ্রেস ঠিক করুক, ওরা কার সঙ্গে থাকবে!” মমতার বক্তব্য ছিল, দক্ষিণ কলকাতায় ভোটের অব্যবহিত আগে তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে মিছিল করে কংগ্রেস আদতে সিপিএমকে সাহায্য করছে! মমতার হুঁশিয়ারির পরেই প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যকে ফোন করে মিছিলের বিষয়ে জানতে চান। প্রদীপবাবু বলেছিলেন যে, তাঁরা জোট ভাঙার জন্য কিছু করছেন না। এ দিনও তিনি বলেন, “মিছিল নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ক্লোজ্ড-চ্যাপ্টার। ওটা নিয়ে এখন আর ভাবছি না।” মিছিলের মূল উদ্যোক্তা যুব কংগ্রেস সভানেত্রী তথা সাংসদ মৌসম বেনজির নুর এ দিনও জানান, মিছিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ঠিকই করেছিলেন। তাঁর কথায়, “ভোটকে কেন্দ্র করে মিছিল করিনি। ভোটের ব্যাপারেও কিছু বলিনি। দলের ছেলেদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। তারই প্রতিবাদ করেছি মিছিলে। আমরা তো জোটেই আছি। জোটকে সমর্থন করছি। এ নিয়ে অযথা বিতর্ক কেন?”
বস্তুত, ‘বিতর্ক’ পিছনে ফেলে কংগ্রেস আপাতত ব্যস্ত রবিবার নেতাজি ইন্ডোরে পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলন নিয়ে। সেখানে প্রধান বক্তা প্রণববাবু। থাকার কথা জয়রামেরও। থাকবেন মৌসম, কংগ্রেসের আরও দুই সাংসদ দীপা দাশমুন্সি, অধীর চৌধুরীও। ওই সম্মেলন থেকে মমতার পঞ্চায়েত-মডেল নিয়ে আপত্তি তোলার কথা ছিল কংগ্রেসের। খানিকটা ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ সেটা হয় কি না, তা-ও দেখার। দেখার, প্রণববাবু কী বলেন। কী বলেন দীপা-অধীর। দীপা বলেন, “যুব কংগ্রেস মিছিলে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। দলের ছেলেরা মার খাচ্ছে। প্রতিকার চেয়ে মিছিল করার সঙ্গে জোটের সম্পর্ক নেই। ওই মিছিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেন কেন, বুঝতে পারছি না।” কংগ্রেস নেতাদের একাংশ মনে করছেন, দক্ষিণ কলকাতায় ভোটের মুখে হাজরা থেকে গাঁধীমূর্তি পর্যন্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের’ অভিযোগ নিয়ে মিছিল করা ‘সমীচীন’ হয়নি। এক সাধারণ সম্পাদকের কথায়, “ভোটটা মিটলে মিছিল করলেই হত। মমতা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন আঁচ করে প্রদেশ কংগ্রেসের অনেক নেতা ওই মিছিলে যাননি।’’ মিছিল নিয়ে কংগ্রেসের কড়া সমালোচনা করেছেন তৃণমূল নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন শিলিগুড়িতে তিনি বলেন, “সন্ত্রাসের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। কোনও সমস্যা হলে তাঁরা আলোচনায় বসতেই পারেন। তা না-করে জোট শরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে মিছিল করা ঠিক নয়।” উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল গড়ার দাবিতে কংগ্রেস রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য, “আন্দোলন তো যে কোনও রাজনৈতিক দল করতেই পারে।” কিন্তু কংগ্রেস তো রাজ্যে জোট শরিক? সুদীপবাবুর উত্তর, “কংগ্রেস জোটে না-থাকলেই বা তৃণমূলের কী সমস্যা হবে?”
তবে রায়গঞ্জে এইমস নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তৃণমূল পাল্টা আন্দোলনে নামবে না বলে জানিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী আবদুল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, “রায়গঞ্জে এইমস আমরাও চাই। তবে জোট শরিক হয়ে তা নিয়ে কংগ্রেস আন্দোলনে নেমে ঠিক করেনি। আমরা জোটধর্ম মেনে চলব। সে জন্য কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাল্টা আন্দোলন করব না। জেলার সার্বিক উন্নয়ন করে কংগ্রেসের অপপ্রচারের জবাব দেব।” প্রত্যাশিত ভাবেই, কলকাতায় যুব কংগ্রেসের মিছিলের সমালোচনা করে করিম বলেন, “মিথ্যে অভিযোগে জোট শরিক এ ধরনের আন্দোলন করলে জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আশা করি কংগ্রেস ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না। যদি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেই হয়, তা হলে জোট ছেড়ে কংগ্রেসের বেরিয়ে যাওয়া উচিত!”
তবে রাজ্য কংগ্রেস সূত্রের খবর, হাইকম্যান্ডকে না জানিয়ে এ ভাবে মৌসম-দীপা মিছিল করায় ‘ক্ষুব্ধ’ প্রণববাবু। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “মিছিলটা যে হচ্ছে প্রণবদা জানতেন না। ফলে কখন, কোথায় ও কেন মিছিল হয়েছে, তা জানতে চেয়েছিলেন উনি।” রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের একাংশের বক্তব্য, আপাতত আলোচনার মাধ্যমে ‘বিতর্ক’ মেটাতে আগ্রহী হাইকম্যান্ড। যেমন এ দিন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শাকিল আহমেদ বলেছেন, “মিছিলটা রাজনৈতিক মিছিল ছিল না। জোটের বিরুদ্ধেও নয়। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মৌনীমিছিল। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকলে দু’দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আলোচনায় বসে তা মিটিয়ে নেবেন। জোট ছিল, আছে, থাকবে।”
এই পরিস্থিতিতে মুকুলবাবুর চিঠির ‘কড়া জবাব’ আপাতত স্থগিত রাখছে কংগ্রেস। জোট না-ভেঙে দু’দলের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ অক্ষুণ্ণ রাখার আর্জি জানিয়ে মুকুলবাবুকে দেওয়ার জন্য চিঠির খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। কংগ্রেস কর্মীদের উপর তৃণমূলের ‘হামলা’র ৬৬টি অভিযোগ জানিয়ে আগেই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেন প্রদীপবাবু। সেই চিঠির জবাব যে এখনও আসেনি, সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই খসড়ায়। তবে চিঠির জবাব দিতে ‘তাড়াহুড়ো’ করতে নারাজ কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রদীপবাবু বলেন, “চিঠির জবাব অবশ্যই দেব। তবে তাড়াহুড়ো নেই।” |