|
|
|
|
‘বদলের’ জমানায় ‘সাচ্চা’ কর্মী বাছাইয়ে আলিমুদ্দিন |
রঞ্জন সেনগুপ্ত ও অত্রি মিত্র • কলকাতা |
বিধানসভা ভোটের অন্তত দু’মাস আগেই দলের নিচুতলার সদস্যদের কাছে আলিমুদ্দিন জানতে চেয়েছিল, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে’ কী ভাবে তাঁরা পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। দলের একাংশের মতে, ভোটের আগেই ফলাফলের ‘আঁচ’ পেয়ে-যাওয়ায় ওই ব্যবস্থা নিয়েছিল সিপিএমের রাজ্য কমিটি। সদস্যদের কাছে রাজ্য কমিটির তরফে দেওয়া খালি ফর্ম-সহ এক সার্কুলারে (ফর্মের শীর্ষক ‘শাখা থেকে জোনাল স্তর পর্যন্ত সদস্যদের মূল্যায়ন ফর্ম: ফেব্রুয়ারি-অক্টোবর, ২০১১’) বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছিল। যা, দলের নেতাদের একাংশের মতে, সিপিএমের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’।
টানা ৩৪ বছর সরকারে থাকার পর ক্ষমতা চলে যাওয়ায় সিপিএমের অভ্যন্তরে সঙ্কট এখন যে ‘গভীর’, তা দলের নেতারাও একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেন। এত দিন সিপিএম মনে করত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রয়াত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে দলকে সব চেয়ে বেশি সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। ’৭৭ সালের ভোটেও তাঁদের কার্যত ‘অন্তরালে’ থেকে কাজ করতে হয়েছিল বলে দাবি করেন দলীয় নেতারা। সেই নেতাদেরই বক্তব্য, “তার পর থেকে এখনকার মতো সঙ্কট আর হয়নি।”
কিন্তু সেই সঙ্কটের আঁচ যে বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগেই সিপিএম নেতারা পেয়েছিলেন, তার ইঙ্গিত দিচ্ছে রাজ্য কমিটির ওই ফর্মের দিন ক্ষণ। এবং তখন থেকেই দলের অভ্যন্তরে শাখা থেকে জোনাল স্তর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হয়েছিল।
সিপিএমের কেউ কেউ অবশ্য দাবি করছেন, এই মূল্যায়ন একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে বিধানসভা ভোটে হারের সম্ভাবনা আন্দাজ করার কোনও সম্পর্ক নেই। সেই দাবি উড়িয়ে দলেরই অন্য অংশ বলছে, সে ক্ষেত্রে এমন ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ প্রশ্ন মূল্যায়ন ফর্মে রাখা হয়েছিল কেন? এবং ওই ফর্ম বিলির সময়কালই বলছে, বিধানসভা ভোটের আগেই ভোট-পরবর্তী সময়ের কথা ভেবে সাংগঠনিক ভাবে তৈরি হতে শুরু করেছিল দল। ওই সময়কাল আরও বলছে, বিধানসভা ভোটের আগে প্রকাশ্যে সরকার গঠনের দাবি করলেও ফলাফল নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কায় ছিলেন সিপিএমের বড়-মাঝারি-ছোট নেতারা। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশক পর ক্ষমতাচ্যুত হলে সংগঠন ধরে রাখা যে কঠিন, তা অনুমান করেই ভোটের দু’মাসেরও বেশি আগে (ছ’দফায় ভোট শুরু হয়েছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি) দলীয় সদস্যদের মনোভাব বোঝার কাজ শুরু করেছিল সিপিএম। সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে নতুন সরকার গঠনের পাঁচ মাস পর, অক্টোবরে।
|
নজিরবিহীন পাঁচ প্রশ্ন |
• কী ভাবে পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান
• এলাকায় প্রত্যাশা মতো ফল হয়েছে কি না
• নিয়মিত লেভি দিতে সম্মত কি না
• পার্টি পত্রিকার গ্রাহক হতে সম্মত কি না
• পরিবারের কেউ প্রোমোটারি, ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত কি না |
|
গত ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া ১২ দফা প্রশ্ন সম্বলিত ফর্মে নিচুতলার পার্টি সদস্যদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ভাবে পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান?’ উত্তর হিসেবে চারটি ‘বিকল্প’ (অপশন) দেওয়া হয়েছে ‘সক্রিয় ও দায়িত্ব নিয়ে’, ‘সব সময় সম্ভব নয়’, ‘সময় পেলে’ এবং ‘সমর্থক হিসাবে’। প্রশ্ন রয়েছে, নিয়মিত ‘লেভি’ দিতে সম্মত? উত্তর দিতে হবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’-এ ‘টিকচিহ্ন’ দিয়ে। প্রসঙ্গত, ‘লেভি’ না-দিলে দলীয় সদস্যপদই থাকে না। সে দিক এই প্রশ্ন ‘অবান্তর’ বলে দলের একাংশের অভিমত। যা খারিজ করে কলকাতা জেলা কমিটির এক সদস্য জানান, ‘লেভি’ না-দিলে যে হেতু সদস্যপদ থাকবে না, তা-ই বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছে। যাঁরা ‘নেতিবাচক’ জবাব দেবেন, তাঁদের আগেই সদস্যপদ থেকে ছেঁটে ফেলা হবে।
সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, যে কেউ প্রথমে দলের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করতে পারবেন। তাঁর কাজকর্ম, শৃঙ্খলা ও আনুগত্যে সন্তুষ্ট হলে দল তাঁকে সদস্যপদ দেবে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পাওয়া রীতিমতো ‘গর্ব’ করার মতো বলেই দলের নেতারা দাবি করে থাকেন। ফর্মে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘পার্টিতে কী ভাবে যুক্ত থাকতে চান?’ দলের একাংশের মতে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে দলের ঊর্ধ্বে সংশ্লিষ্ট সদস্যের ইচ্ছাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যা কমিউনিস্ট পার্টিতে অভাবনীয়। তবে রাজ্য কমিটির এক সদস্যের ব্যাখ্যা, “দল সরকারে না-থাকলে যে অনেকেই বসে যাবেন বা উল্টো স্রোতে গা ভাসাবেন, তা জানা ছিল। এ নিয়ে দলের মধ্যে বহু আলোচনাও হয়েছে। তাই বিরোধী পক্ষে থাকার সময় কারা দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান এবং কী ভাবে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া ছাড়া তা জানার আর কী উপায় ছিল?”
সিপিএম নেতাদের একাংশের মতে, সার্কুলারে স্পষ্ট, দলীয় অনুশাসনের নামে কিছু চাপিয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে না। আগে দলীয় সদস্যদের কাছে জানতে চাওয়া হত, দলীয় পত্রপত্রিকার মধ্যে তিনি কীসের গ্রাহক? এ বারের প্রশ্ন কিন্তু, ‘গ্রাহক হতে সম্মত আছেন?’ গত কয়েক বছর ধরে নেতারা বলে আসছেন, দলের কেউ প্রোমোটারির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। সেই সংক্রান্ত প্রশ্নও রয়েছে। বলা হয়েছে পরিবারের কেউ ঠিকাদারি, প্রোমোটারি, আয়কারী (ফায়দাজনক) প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যুক্ত? জানতে চাওয়া হয়েছে, পার্টি ও গণফ্রন্টের ‘অর্পিত দায়িত্ব’ পালনে সম্মত কি না।
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়শই বলতেন, সংগঠন মজবুত না-করলে সিপিএমের সঙ্গে
লড়াই সম্ভব নয়। তাই তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের উপর সংগঠন গড়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিরোধী জোটের পাশাপাশি লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পিছনে মুকুলবাবুর হাতে গড়া সংগঠনেরও ভূমিকা ছিল বলে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মনে করেন।
অন্য দিকে, ক্ষমতা হারিয়ে সিপিএমের সঙ্কট আপাতত এতটাই যে, সব জায়গায় দলীয় কার্যালয় খোলারও লোক পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক এলাকায় একাধিক কমিটিকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলের নিচুতলার নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের সমম্বয়ের অভাবের অভিযোগও আসছে। এর সঙ্গে রয়েছে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে দল ছাড়ার হিড়িক। প্রকাশ্যে সিপিএমের অভিযোগ, নতুন শাসক তৃণমূলের ‘আক্রমণে’ কর্মীরা ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে লোকবলেও যে টান পড়েছে, একান্ত আলোচনায় তা-ও মানছেন নেতাদের একাংশ।
এই পরিস্থিতিতে দলীয় সদস্যদের মূল্যায়ন করে কী পাওয়া গেল? দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “প্রাথমিক বিচারে যতটা খারাপ হবে ভাবা হয়েছিল, ততটা হয়নি। তবে পুরো ছবি এখনও পরিষ্কার নয়। মার্চ মাসে সদস্য পুনর্নবীকরণ কর্মসূচি শেষ হলে বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে।” দলীয় সূত্রের খবর, চলতি মাসে শুরু-হওয়া সিপিএমের আঞ্চলিক কমিটিগুলির সম্মেলনের প্রাক্-মুহূর্তেও কোনও কোনও এলাকায় সার্কুলার মেনে ফর্ম পূরণের তোড়জোড় চলছে। |
|
|
|
|
|