শরীরের সব রক্ত মুখে এসে হাজির হলে শরীর বিপন্ন হয়,
মুখও বাঁচে না। ক্রিকেটসর্বস্ব ভারতের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত শৈবাল কর |
পরিভাষায় হ-য-ব-র-ল। তবে অজানা জ্বর নিয়ে ভীতি প্রদর্শনের কোনও দুরভিসন্ধিও এতে নেই। ক্রিকেট খেললে বা তন্দুরি-চিকেন খেলে ব্যক্তিবিশেষের ‘ডাচ্ ডিজিজ’ হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। এটি আসলে একটি অর্থনৈতিক অসুখ। প্রবন্ধের শিরোনামে প্রথম দু’টি শব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীর। একটু বিস্তারিত বলা যাক।
ইংল্যান্ডে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটবাহিনীর ভরাডুবি এবং ভারতে এসে ইংল্যান্ড দলের চুনকাম একেবারেই নিজের পাড়ায় দাদাগিরি। হোম গ্রাউন্ডের সুবিধে। ব্যাপারটি তেমন খারাপও নয়; নিজের রাজ্যের এক চুল জমিও কেউ ছাড়তে রাজি নন। অবশ্য, এই রাজ্যপাট এবং বিশ্ব ক্রিকেট সারণিতে দেশের অবস্থান বজায় থাকে অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমী সাধারণ মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। আর তা হবে না-ই বা কেন? অন্তত ক্রিকেটে তো ভারত দু’-দু’বার বিশ্বসেরা। হকি-র স্বর্ণযুগ পার হয়ে আর কোন খেলাতেই বা তা সম্ভব হয়েছে? স্বাভাবিক কারণেই ক্রিকেটের ‘বাজার’ জমজমাট। তবে, মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা মানুষ বরাবরই দেখতেন এবং তার সঙ্গে ফুটবল-হকিও দেখতেন। টেলিভিশনে ক্রমাগত ক্রিকেট এবং ১৯৮৩-তে কপিল দেবের চওড়া কাঁধে বিশ্বকাপের স্থান একটি উন্নয়নশীল দেশের কাছে অভাবনীয় বিজ্ঞাপন হয়ে দেখা দিল। তার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার কৃতিত্বে সারা উপমহাদেশেই ক্রিকেটের অবিংসবাদী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। দুর্ভাগ্যবশত প্রায় একই সঙ্গে যাবতীয় অন্য খেলার অবস্থা হল টিমটিমে পার্শ্বচরিত্রের মতো। সমস্ত আগ্রহ ও উন্মাদনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়ে গেল ক্রিকেট এবং বাজার ব্যবস্থায় কোন দিকে ঝুঁকবে পুঁজি, তারও নির্ণয় হল।
আরও সম্প্রতি, ক্রিকেটের উন্মাদনাকে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে বাজারে এল নতুন ‘ফাস্ট ফুড’ ক্রিকেট আই পি এল। পৃথিবীর আট-দশটি ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের কাছে ভারতের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন এই মুহূর্তে। ‘তন্দুরি চিকেন’-এর মতো। এক ডাকে চিনবে সারা বিশ্ব। উন্নত বিশ্বের কাছে দক্ষিণ এশীয় রান্নার প্রধান পরিচয়। তাবড় রেস্তোরাঁয় লাল রঙের তন্দুরি চিকেন এক বারও খাননি এমন বিদেশি ইউরোপ-আমেরিকায় তেমন বেশি নন সংখ্যায়। এটা আমাদের ‘আইডেন্টিটি’, দারিদ্রের মতো, মাদার টেরিজার মতো, সত্যজিৎ রায়ের মতো। এতেই আমাদের তুলনামূলক সুবিধা বা দক্ষতা অন্যদের থেকে ভাল পারি। আমরা নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু ভাল পারি বিজ্ঞানে, অঙ্কে, দাবায়, সফটওয়্যারে। এতেও বেশ পরিচিতি হয়েছে, তবে তন্দুরি-চিকেন বা সচিন তেন্ডুলকরের সমান নয়। এঁরা একমেবাদ্বিতীয়ম্। এটা সুখবর। এবং এটাই সমস্যা।
জি-২০ বা ‘ব্রিক’ দেশগুলির (ব্রাজিল, রাশিয়া, চিন) সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এবং তুলনা উত্থাপিত হয় সর্বত্র। এই দেশগুলিতে অন্তত তিন-চারটি জনপ্রিয় খেলার নাম সহজেই বলা যায়, যাতে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়রা যুক্ত, যে কোনও দিন। অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, বিচ ভলিবল, বাস্কেটবল, টেনিস এবং সর্বোপরি ফুটবল তো আছেই। ভেবে দেখুন আফ্রিকার তুলনায় গরিব দেশগুলির কথা। ইউরোপের নামী-দামি ক্লাবগুলিতে আফ্রিকার ফুটবল খেলোয়াড়দের আধিপত্য যথেষ্ট। দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স বা অস্ট্রেলিয়াতে রাগবি ফুটবল-ক্রিকেটের চেয়ে কিছু কম জনপ্রিয় নয়, দর্শকাসন কখনও খালি যায় না। সরকারি সাহায্যে প্রাথমিক ভাবে স্টেডিয়াম বা জিমনেসিয়ম ইত্যাদি তৈরি হয়ে থাকলেও এই খেলাগুলি পুরোপুরি বাজারমুখী এবং সফল। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের অধিকাংশ স্টেডিয়াম ইদানীং তৈরি হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির অর্থে। আমেরিকায় সে দেশের ফুটবল, বাস্কেটবল, আইস হকি, টেনিস সবই অসম্ভব জনপ্রিয়; খেলোয়াড়রাও ব্যক্তিগত মুনশিয়ানার ভিত্তিতে রোজগার করে থাকেন। লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্স-এর কোবে ব্রায়ান্ট বিশ্ববিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড়। তাঁর বাৎসরিক চুক্তির অঙ্ক আড়াই কোটি ডলারের কাছাকাছি এবং সেটা বাজার-নির্ধারিত। চিন, মেক্সিকো, আর্জেন্তিনা, জার্মানি এবং আরও বহু দেশের খেলোয়াড় এন বি এ-তে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আমেরিকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের দু’জন সাত ফুট লম্বা খেলোয়াড়ের সম্ভাবনা নিয়ে প্রচুর আলোচনা চলছে এই সময়। সকার-এর মাঠে বেকহ্যাম এবং রবি কিন-এর উপস্থিতি সারা বিশ্বের নজর কাড়ছে। অভিবাসীদের দেশ আমেরিকায় একদা ব্রাত্য ‘সকার’ জনপ্রিয় হচ্ছে হু-হু করে। এতগুলি সম্ভাবনার অর্থনৈতিক দিকটি অবহেলা করা সয় কি? সমস্ত প্রতিভা একটি মাত্র খেলায় আটকে থাকলে তার খেলোয়াড়ি বা অর্থনৈতিক সুফল কতটুকুই বা বিস্তৃত হতে পারে? এটাই অর্থনীতির পরিভাষায় ‘ডাচ ডিজিজ’।
কথাটা এল কোথা থেকে? গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নর্থ সি-তে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়। লাগোয়া দেশগুলির কাছে এই আবিষ্কার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার একটি দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। কয়লার ভাণ্ডার তলানিতে, অন্যত্র তেল নেই এই অবস্থায় হল্যান্ডের অর্থনীতি ভয়ানক রকম নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের এই ভাণ্ডারের ওপর। ব্রিটেন-সহ পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। হল্যান্ডে সরকারি এবং বেসরকারি দু’ধরনের পুঁজিই বিপুল ভাবে নিয়োজিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণের ব্যবসায় এবং বাকি সব শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চরম নির্ভরশীলতা যে একটি দেশের উৎপাদনের ভিত বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, তার মোক্ষম পরিচয় হল ‘ডাচ ডিজিজ’। পরবর্তী কালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনিয়ায় কফির দাম বেড়ে অতিরিক্ত উৎপাদন করার লক্ষ্যে শিল্প-সম্ভাবনা সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাহত হয়।
ক্রিকেট-আবেগ সম্ভবত ভারতীয় ক্রীড়াজগৎকে একই পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ছায়াছবির নক্ষত্র থেকে শুরু করে রাজনীতিকদের অতি-উৎসাহ ক্রিকেটকে সাহায্য করেছে অনেক এবং অন্য খেলাগুলিকে পিছিয়ে দিয়েছে ততটাই। ফুটবলে যেটুকু পুঁজি এসেছে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে, তা ক্রিকেটের তুলনায় সামান্য। বাস্কেটবল, ভলিবল বা হকির মতো জনপ্রিয় খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। ময়দানের রাজ্য বাস্কেটবল কোর্টে এক জনকে বলতে শোনা গেল কিছু দিন আগে যে, মাঠটিকে টেনিস কোর্ট করে দিলে হয়তো কাজের কাজ হত। দেশের এবং রাজ্যের বিভিন্ন অফিস ক্লাব ক্রিকেটের একাধিপত্যকে মাথা চাড়া দিতে দেয়নি বহু দিন, তারাও আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অচিরেই চাকরির বাজারে ক্রিকেট ব্যতীত সব খেলা ব্রাত্য হয়ে পড়বে। অথচ, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে নাম করা ক্রিকেটার হয়েছেন এমন উদাহরণ অমিল। ফুটবল, ভলিবল, সাঁতারে এঁরা বরাবর অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ফুটবলের রাজপুত্ররা উঠে এসেছেন গভীর অভাবের জগৎ থেকে, খেলাটি বজায় ছিল বলেই। ক্রিকেটের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এঁরা হয়তো কোনও দিন জোগাড় করে উঠতে পারতেন না।
খেলার উৎকর্ষের নিরিখে না হোক, অর্থনৈতিক কারণে অন্তত এই বাউন্ডারি পেরনোর প্রয়োজন অপরিসীম। |
কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক |