একবার না পারিলে দেখ শতবার, এই প্রবচন বঙ্গীয়কুলের অজানা নহে। শত বারে কাজটি হইতে পারে, না-ও পারে। তাই বলিয়া কি শতবার প্রয়াসের মহত্ত্ব বৃথা হইবে? না, হইতে পারে কখনও? শতক একটি বিচিত্র কিংবদন্তি। তাহাই কি নির্জলা সত্য? নহে। তাহা হইলে কি মিথ্যা? নহে। বস্তুত, শতক এক কল্পলোক। সত্য বা মিথ্যার আলো এবং অন্ধকারের সহজিয়া বিভাজনের ঊর্ধ্বে। সংখ্যার ক্রম এক ছাড়িয়া দুইতে পৌঁছাইল, তাহার পর চলিতে চলিতে শেষে তিন। এক শূন্য শূন্য। ইহাই সেই মাইলফলক, যাহার জন্য মানব তৃষ্ণার্ত। কেহ শতবর্ষ বাঁচিতে চাহেন। কেহ শতপুষ্প বিকাশের স্বপ্ন দেখেন। কেহ বা শতরান করিতে চাহেন। লক্ষ্যটি এক। এক শূন্য শূন্য।
কবি বলিবেন, এই শূন্য প্রকৃতপক্ষে শূন্য নয়। একের পিঠে দুইটি শূন্য নির্মাণ করে এক অসম্ভবের মায়া। এবং, তাহাকে সম্ভব করিবার দুঃসাহসী প্রস্তাবটি থাকে অনুষঙ্গে। পারো তো করিয়া দেখাও। স্পর্শ করো এই দুরূহ শৃঙ্গ। প্রয়াস চলে। কখনও সাফল্য। সফল হইলে মোমবাতি, আলোকচিত্রীর ঝলকানি, প্রভূত গুণকীর্তন। বিফল হইলে অনন্ত আক্ষেপ। কী হইতে কী হইয়া গেল, শত-স্পর্শ আর এই যাত্রায় হইল না। যেমন, সচিন তেন্ডুলকর। ইডেন উদ্যানের দীর্ঘশ্বাস গঙ্গার হিমবিজড়িত বাতাসে মিশিয়া যায়। যাহা চাই, তাহা পাইলাম না। শতরান তো হইল, কিন্তু হায়, এমন মধুর রানের খেলায় কেন সে দেয় ফাঁকি? প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করে। পঞ্চম দিনের সূর্যেরও একই প্রশ্ন। টেস্ট ক্রীড়া তাহার পরে আর গড়ায় না। এমনকী, অনেক সময় তত দিনও গড়ায় না। সুতরাং, উত্তর মিলে না। সচিন তেন্ডুলকর ক্যানভাসে তুলিচালনা করেন। তৎপর বিমানযোগে উড়িয়া যান। মুম্বই প্রতীক্ষায় থাকে। আহা, যদি...! তিনি আপাতত নিরানব্বইতে স্থিত। আর মাত্র একটি। হইলেই কীর্তিস্তম্ভ আকাশপানে ধাবিত হইবে! এক শূন্য শূন্য।
মাত্র এক-এর দূরত্বে পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে সাফল্যের হাসি এবং ব্যর্থতার বেদনা। তেন্ডুলকর অষ্টাদশ শতকের পূর্বে জন্মান নাই। জন্মিলে হয়তো অন্য এক সংকটে পড়িতেন। তদানীন্তন ব্রিটেনে ‘হান্ড্রেড’-এর দুইটি মূল্যমান ছিল। এক শূন্য শূন্য ছিল পরিভাষায় ‘স্মল হান্ড্রেড’! এক দুই শূন্য ছিল ‘লং হান্ড্রেড’! সেই ভূভাগ হইতে রোমানগণ চলিয়া যাইবার পরে যে টিউটনিক জাতি রাজত্ব কায়েম করিয়াছিল, এই ভেদ-বুদ্ধি তাহাদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই ভেদাভেদ এখনও থাকিলে নাছোড় সাংবাদিককুল প্রশ্ন তুলিত, তাঁহার শতরানের কয়টি ছোট এবং কয়টি বড়! শুধাইত, আর একটি শতরান করিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘ছোট শতক’টি না হয় হইল, কিন্তু ‘বড় শতক’! সে দিন আর নাই। শতকিয়া তাহার নিজস্ব মহিমায় স্থিত। তাহাতে সচিন তেন্ডুলকরের সুবিধা! আমজনতারও। শতাংশের হিসাব কষিতে বসিলে ‘ছোট-বড়’-র খটকা মাথায় রাখিতে হইবে না। ‘কেক’-এর ভিতর মাত্র একশোটি মোমবাতি বসাইতে পারিলেই উল্লাসে সফেন হওয়া চলিবে। নূতন সরকার শপথ লইবার পরে একশোটি দিন নির্বিঘ্নে কাটাইতে পারিলেই করমর্দনের ঢেউ উঠিবে! নিরানব্বই নহে। একশত। একের পিঠে শূন্য, তাহার পিঠে শূন্য। দুই সংখ্যা হইতে লাফ দিয়া তিন সংখ্যা। কেন যে মন ভোলে, তাহা মন জানে না... |